খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৪ এপ্রিল ২০১৬: স্কোরবোর্ডে মাত্র ১১ রান। ড্রেসিংরুমে ফিরে এসেছেন ক্রিস গেইলসহ টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাহলে ম্যাচ জেতাবেন কে? ইডেনে ইংল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ১৫৬ রানের লক্ষ্য অতিক্রম করাবে কার ব্যাট?
কাল রাতে ক্যারিবীয় সমর্থকদের শিরায় যখন এই শঙ্কার স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, তখনো আশায় মাশরাফি বিন মুর্তজা। না, বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক হঠাৎ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমর্থক হয়ে যাননি। তবে যাকে কাছ থেকে দেখেছেন, যার সঙ্গে একই দলে খেলেছেন এবং যাকে দেখেছেন বিপদে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে; তার ওপর থেকে আস্থা হারান কীভাবে! মুঠোফোনে সেই স্নায়ুক্ষয়ী সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে মাশরাফি বললেন, ‘৩ উইকেট পড়ার পর আমার মনে হয়েছিল আজকেই স্যামুয়েলসের দিন। টুর্নামেন্টের আগের ম্যাচগুলোতে তেমন ভালো খেলেনি। তবু মনে হচ্ছিল, ওই সময় স্যামুয়েলস যদি না পারে আর কেউ পারবে না। ওদের মারার ব্যাটসম্যান ছিল, কিন্তু নতুন করে ম্যাচ গড়ার মতো ব্যাটসম্যান তখন ছিল একমাত্র স্যামুয়েলসই।’
ক্যারিবীয় অধিনায়ক ড্যারেন স্যামির আস্থা যেমন রেখেছেন, স্যামুয়েলস মর্যাদা রেখেছেন বাংলাদেশে বসে টেলিভিশনে খেলা দেখা তাঁর আরেক অধিনায়কের বিশ্বাসেরও। হ্যাঁ, গত বিপিএলের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসে খেলার সুবাদে মাশরাফিও জ্যামাইকান এই ব্যাটসম্যানের একজন অধিনায়ক। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দেওয়া অপরাজিত ৮৫ রানের ইনিংসটির জন্য দূরদেশের এই অধিনায়কের প্রশংসায় সিক্ত হলেন স্যামুয়েলস, ‘ও প্রমাণ করল মাহেলা জয়াবর্ধনের পর সে-ই একমাত্র ফাইনাল ম্যাচের খেলোয়াড়। ফাইনালে মাহেলার ভালো খেলা ছিল অবধারিত, এখন স্যামুয়েলসও নিজেকে সে জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বকাপে এর আগেও সে অবিশ্বাস্যভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চ্যাম্পিয়ন করেছে।’
ঢাকায় টেলিভিশনের সামনে বসে মাশরাফি যেভাবে ছক কষছিলেন, ইডেন গার্ডেনে স্যামুয়েলসের ইনিংসও এগিয়েছে ঠিক সেই পথে, ‘হয়তো একসঙ্গে একই দলে খেলাতেই ওর চিন্তার সঙ্গে আমার চিন্তা মিলে যাচ্ছিল। খেলা দেখার সময় আমি যখন যেটা করা দরকার মনে করছিলাম, ও সেটাই করছিল। স্যামুয়েলসকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো আমার সব হিসেব মিলে যাচ্ছিল।’
মাশরাফির বিশ্লেষণ বলছে, স্যামুয়েলস দায়িত্ব নিয়ে না খেললে শেষ ওভারের অনেক আগেই হেরে যেতে পারত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো খেলাটা স্যামুয়েলসই তৈরি করেছে। আদিল রশিদ যেরকম বোলিং করেছিল, অন্য ব্যাটসম্যান হলে উইকেট দিয়ে দিত। কিন্তু স্যামুয়েলস খুবই দায়িত্বশীল ইনিংস খেলেছে। ওভার প্রতি ১০ করে রান নিতে হতো। সে অপেক্ষা করেছে পেস বোলারদের জন্য। স্যামুয়েলস উইকেটে ছিল বলেই অন্য ব্যাটসম্যানরা মারার সুযোগ পেয়েছে। ব্রাফেট শেষ ওভারে চারটি ছয় মারলেও আগের ওভারে প্লাঙ্কেটকে তিন ছয় মেরে স্যামুয়েলসই তো খেলা ক্লোজ করে আনল!’
অথচ স্যামুয়েলসসহ অন্য ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের সম্পর্কে কদিন আগেও অন্য ধারণা ছিল মাশরাফির, ‘আগে মনে করতাম ওরা বুঝি শুধু পাওয়ার ক্রিকেটই খেলে।’ ভুল ভাঙল বিপিএলে। স্যামুয়েলসকে মাত্র চার ম্যাচের জন্য পেয়েছিল মাশরাফির দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস। ওই চার ম্যাচেই তিনি দেখিয়ে দিলেন ব্যাটের জাদু। চার ম্যাচে ১৪২ রান! ‘বিপিএলে এক সঙ্গে খেলার পর বুঝেছি ও কতটা দায়িত্বশীল ব্যাটসম্যান। ব্যাটিংয়ের আগে কারও সঙ্গে কথা বলে না। এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকে। পুরো খেলাটা ড্রেসিংরুমের বাইরে বসে দেখে’-কথাগুলো যেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়েই বলছিলেন মাশরাফি। আর মানুষ স্যামুয়েলস্ত সেখানেও নেতিবাচক কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না মাশরাফি, ‘অসাধারণ। আমাদের দেশের হলে ওকে সবাই ‘মুডি’ ভাবত। কিন্তু বাস্তবে খুবই বন্ধুসুলভ, দলের যেকোনো ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। মাঠে খুব কম কথা বললেও যেটুকু দরকার তা করে। শুনেছি ফাইনালের পরে সংবাদ সম্মেলনে নাকি ও টেবিলে পা তুলে বসেছিল। হয়তো কোনো সমস্যার কারণেইৃওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা সাধারণত কারও প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য কিছু করে না। ওরা সব সময়ই জীবনটা উপভোগ করতে চায়।’
এখন তো সেটা আরও বেশি হবে। সপ্তাহান্তের স্ট্রিট পার্টিগুলোতেও নিশ্চয়ই বাড়তি উন্মাদনা ছড়াবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ‘ডাবল’ জয়। স্যামুয়েলসের কারণেই সেখানে না থেকেও থাকবেন মাশরাফি।