খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল ২০১৬: জ্বালানি তেলের (ফার্নেস তেল) দাম কমায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমতে শুরু করেছে প্রায় এক বছর আগে থেকে। সরকার গত ৩১ মার্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস তেলের দাম কমিয়ে দেওয়ায় উৎপাদন খরচ আরও কমবে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে উল্টো বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা যুক্তিহীন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে ব্যবসা-বাণিজ্য চাপের মুখে পড়বে। আর সাধারণ মানুষ বলছে, তাদের কাঁধে চাপবে খরচের জোয়াল।
বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুতের প্রায় ৭২ শতাংশ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। গ্যাসের দাম ২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বরের পরে আর বাড়েনি। আর ২০ শতাংশের কিছু বেশি বিদ্যুৎ আসে ফার্নেস তেল থেকে, যার দাম এক বছর ধরে কমছেই। এর বাইরে বাকি বিদ্যুৎ আসে কয়লা ও পানি থেকে।
গত পাঁচ বছরে ছয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে শেষবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় মাত্র আট মাস আগে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম আড়াই টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ছয় টাকা হয়েছে।
শুধু বিদ্যুৎ না, একই সঙ্গে গ্যাসের দাম বাড়ানোরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বলেছেন, এ দুটোর দাম বাড়ালে উৎপাদন খাত ও ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বর্তমানে বিদ্যুতের যে দাম, তা-ই সব ব্যবসায়ী দিতে পারছেন না ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা থাকার কারণে। অনেকেই বিদ্যুৎ বিলখেলাপি হচ্ছেন। এখন আবার দাম বাড়ালে খেলাপি গ্রাহক আরও বাড়বে। শিল্পকারখানা বন্ধ হবে।’
জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ নীতির (এনার্জি প্রাইসিং পলিসি) গবেষক, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাসভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়ে গেছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম কমে এসেছে। এ অবস্থায় বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে যেসব কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত কম, সেগুলো বেশি চালানো হলে এখনই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বিক্রির দামের চেয়ে কম হতে পারে। কিন্তু তা না করে দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ এ খাতে সুশাসনের পরিচায়ক নয়।
দেশে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয়েছিল তীব্র বিদ্যুৎ-সংকট মেটানোর জন্য তেলচালিত ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করায়। জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ আইনের আওতায় স্থাপিত এসব কেন্দ্র বিদ্যুৎ-সংকট যেমন মিটিয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতেও সহায়ক হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বি আইডিএস) এক সমীক্ষায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে সব শ্রেণির গ্রাহকের কাছে বিদ্যুতের বিল একটি বোঝা হিসেবে চেপে বসেছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান এ আর খান বলেন, কোনো কোম্পানি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠালে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেওয়া বিইআরসির দায়িত্ব। সে রকম কিছু প্রস্তাব আসায় বিইআরসির কারিগরি দল সেগুলো পরীক্ষা করে দেখছে। তবে দাম বাড়াতে হলে প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশ দাখিল করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে প্রমাণ করতে হবে যে বর্তমান অবস্থায়ও দাম বাড়ানোর প্রয়োজন আছে।
বিদ্যুতের পাশাপাশি সিএনজিসহ সব গ্রাহকশ্রেণির গ্যাসের দামও বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও কয়েকটি গ্যাস বিতরণকারী সংস্থার সূত্রে জানা গেছে। জ্বালানির দাম কমায় বিদ্যুতের গড় উৎপাদন এখন ছয় টাকার মধ্যেই রয়েছে, গ্রাহকেরাও এই দামেই বিদ্যুৎ কিনছে।
ঢাকার মিরপুরের গৃহিণী আয়শা খাতুন (সেকশন-৬, ব্লক-বি, লেন-২, বাড়ি-২৬) বলেন, দুই কক্ষের একটি বাসায় তাঁরা থাকেন। তবে তাঁদের আলাদা মিটার নেই। প্রতি মাসে বিল দিতে হয় ১ হাজার ২০০ টাকারও বেশি। কয়েক দিন আগে বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। তাহলে তো বিদ্যুতের বিল শোধ করাই হবে তাঁদের বড় এক সমস্যা।
সেগুনবাগিচায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মচারী ইসমাইল হোসেন বলেন, এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তা হবে জুলুমের শামিল। সচিবালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী বলেন, সরকার বেতন-বাতা বাড়িয়েছে। এখন আবার তা উশুল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাকশিল্প। এই শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখনো অনেক কম থাকার পরও কেন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেটি বুঝতে পারছি না।’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সূত্র জানায়, একসময় তেলের উচ্চ মূল্যের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছিল। গত বছরও প্রতি ইউনিট (১ কিলোওয়াট) বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ৬ টাকা ২৭ পয়সা। কিন্তু এরপর তেলের দাম কমতে থাকায় এবং ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা কম দামে সরাসরি তেল আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় এ বছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমে হয়েছে ৫ টাকা ৮০ পয়সা। ওই ১১টি ছাড়া আরও প্রায় ১৫টি কেন্দ্রে বিপিসির সরবরাহ করা উচ্চমূল্যের (প্রতি লিটার ৬০ টাকা) তেল ব্যবহার করা হচ্ছিল। সরকার গত ৩১ মার্চ ওই সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস তেলের দামও লিটারপ্রতি ১৮ টাকা কমিয়ে দিয়েছে।
এ ছাড়া বেসরকারি খাতের গ্যাসভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ায় (সামিটের বিবিয়ানা ও ইউনাইটেডের আশুগঞ্জ মডিউলার কেন্দ্র) জাতীয় গ্রিডে আরও কম দামের বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে। এসব কারণে চলতি বছর বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় আরও কমবে। ২০০৯-১০ সালে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো শুরু করার সময় সরকার বলেছিল, ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ বিদ্যুতের দাম আর না বাড়িয়ে বরং কমানো সম্ভব হবে। কেননা, গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়ে যাওয়ার কথা এই সময়ে। বড় কেন্দ্রগুলো চালু হলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ আরও কমে যেত। কিন্তু সরকার সময়মতো সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
বিইআরসি সূত্র জানায়, তাদের কাছে দেওয়া দাম বাড়ানোর প্রস্তাবগুলোর মধ্যে পিডিবি বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রির জন্য বিদ্যুতের পাইকারি দাম ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে। আর সাধারণ গ্রাহকের ক্ষেত্রে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ; ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ৮ দশমিক ৮৬; পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ১০ দশমিক ৭৬ এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রস্তাবগুলো অনুযায়ী সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে গড়ে প্রায় ৮ শতাংশ। এর সঙ্গে মূসক প্রভৃতি হিসাব করা হলে যে গ্রাহক এখন এক হাজার টাকা বিল দেন, তাঁর বিল দাঁড়াবে ১১ শ টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গত সেপ্টেম্বরে বিইআরসির গণশুনানির সময় তাঁর সংগঠন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে বরং কমানোর যুক্তি উপস্থাপন করে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বিইআরসি সে বিষয়টি গণশুনানিতে অন্তর্ভুক্ত করেনি।
বিইআরসির সূত্র জানায়, গ্যাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে গত মঙ্গলবার বিইআরসিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। অন্য কোম্পানিগুলোও প্রস্তাব পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের দাম আবাসিক শ্রেণিতে দুই চুলার জন্য ১ হাজার ২৫০ টাকা এবং এক চুলার জন্য এক হাজার টাকা প্রস্তাব করার চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিল্প-বাণিজ্য ও সিএনজিসহ সব গ্রাহক শ্রেণিতেই গ্যাসের দাম অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।
সরকারের নীতি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত থেকে পুরোপুরি ভর্তুকি প্রত্যাহার করা। তা ছাড়া প্রয়োজনীয় গ্যাস না থাকায় সরকারকে আরও কিছু তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের দামও শেষ পর্যন্ত সাত-আট টাকার কম পড়বে না। তাই বিদ্যুতের দাম কিছু কিছু করে বাড়াতে হবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম তামিম বলেন, এর আগেরবারও দাম বাড়ানোর পক্ষে জোরালো যুক্তি ছিল না। এখন জ্বালানির দাম কমানোর পর তো সে যুক্তি আরও নাজুক হয়েছে।