খোলা বাজার২৪, বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০১৬ : দেশের বৃহত্তম ও গভীরতম জামালগঞ্জ কয়লা খনিতে আহরণযোগ্য গ্যাস নেই। খনিটিতে দুটি অনুসন্ধান কূপ খননের ফল বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। খননকৃত কূপ দুটি থেকে পাওয়া তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে খনি থেকে গ্যাস বের হয়ে গিয়েছে। এই ধারণার কারণ খনির মধ্যে ভূস্তরে এবং কয়লার স্তরে অনেক ফাটল রয়েছে। এগুলো হয়তো কোনো ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এবং এসব ফাটল দিয়ে গ্যাস বের হয়ে গেছে। তবে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের অংশ হিসেবে সেখানে আরও একটি কূপ খননের কাজ চলছে।
প্রতিটি কয়লা খনিতে প্রাকৃতিকভাবেই কম-বেশি মিথেন গ্যাস থাকে। খনিতে কূপ খনন করে সেই গ্যাস তুলে শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা অন্য কোনো ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কয়লা খনি থেকে গ্যাস তোলার এই পদ্ধতির নাম ‘কোল বেড মিথেন’ যা সিবিএম নামে পরিচিত।
জামালগঞ্জ কয়লা খনি থেকে গ্যাস তোলার এই প্রজেক্টের মনিটরিং কনসালট্যান্ট বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতুর্জা আহমেদ ফারুক বলেন, খনিটিতে গ্যাসের সম্ভাব্য পরিমাণ ও খনির অভ্যন্তরে গ্যাস চলাচলের ব্যবস্থা (পারমিঅ্যাবিলিটি) খতিয়ে দেখতে তাঁরা তিনটি কূপ খননের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে দুটি কূপ খনন শেষ হয়েছে। এই কূপ দুটি থেকে তোলা কয়লা ও গ্যাস খনিমুখেই পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ ভ্রাম্যমাণ ও অস্থায়ী পরীক্ষাগার (ল্যাবরেটরি) স্থাপন করা হয়। তাতে কিছু গ্যাসের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলেও তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আহরণযোগ্য নয়।
ফারুক বলেন, খননকৃত কূপ দুটি থেকে পাওয়া তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে খনি থেকে গ্যাস বের হয়ে গিয়েছে। এই ধারণার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, খনির মধ্যে ভূস্তরে এবং কয়লার স্তরে অনেক ফাটল রয়েছে। এগুলো হয়তো কোনো ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এবং এসব ফাটল দিয়ে গ্যাস বের হয়ে গেছে।
কয়লাসমৃদ্ধ অনেক দেশ সিবিএম পদ্ধতিতে গ্যাস আহরণ করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছে। সবচেয়ে বেশি করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারতসহ অনেক দেশেই সিবিএম পদ্ধতি চালু আছে। ভারতের ৩৩টি কয়লা ব্লক উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) আওতায় দেশি-বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে সিবিএম পদ্ধতিতে গ্যাস তোলার জন্য।
জামালগঞ্জ কয়লা খনিতে কী পরিমাণ গ্যাস থাকতে পারে, তার কতটা উত্তোলনযোগ্য এ সব খতিয়ে দেখার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি করছে পেট্রো বাংলার নিযুক্ত ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মাইনিং অ্যাসোসিয়েটস প্রাইভেট লিমিটেড’। গত ৫ জানুয়ারি তাঁরা প্রকল্পের কাজ শুরু করে। জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জে স্থানভেদে প্রায় ৫০০ মিটার থেকে এক কিলোমিটার গভীরতায় খনিটির অবস্থান। সেখানে কয়লার মজুত প্রায় ১০০ কোটি মেট্রিক টন।
তবে এত গভীর খনি থেকে সুরঙ্গ কিংবা উন্মুক্ত কোনো পদ্ধতিতেই কয়লা তোলা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়। সে জন্য দেশের জ্বালানি ও খনি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজ অনেক দিন থেকেই সিবিএম প্রকল্প গ্রহণের কথা বলে এসেছেন। সরকার জামালগঞ্জে প্রথমবারের মত সিবিএম প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়।
সব কয়লা খনিতেই কম-বেশি গ্যাস থাকে। তবে গ্যাস কম-বেশি থাকা নির্ভর করে কতগুলো বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে খনির গভীরতা ৫০০ মিটারের বেশি থেকে এক হাজার মিটারের মধ্যে হলে, খনিতে ‘হাই ভোলাটাইল বিটুমিনাস’ কয়লা থাকলে এবং খনির অভ্যন্তরে কয়লার স্তর বেশি পুরু হলে বেশি গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জামালগঞ্জে এর সবগুলোই বিদ্যমান। সে জন্যই সিবিএমের জন্য এই খনিটি বেছে নেওয়া হয়েছিল।
১৯৯০-এর দশকে জার্মান প্রতিষ্ঠান বিএইচপি মিনারেল জামালগঞ্জ খনিতে গ্যাসের অবস্থানের বিষয়ে কিছু পরীক্ষা চালিয়েছিল। এর ফল বিশ্লেষণ করে বিএইচপি তখন বলেছিল, এই কয়লা খনিটিতে ছোট থেকে মাঝারি আকারের একটি গ্যাস ক্ষেত্রের সমপরিমাণ গ্যাস থাকার সম্ভাবনা আছে।
জাতিসংঘের সহায়তাপুষ্ট কয়লা অনুসন্ধান কর্মসূচির আওতায় ১৯৬২ সালে জামালগঞ্জ কয়লা খনিটি আবিস্কৃত হয়। দেশে এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত পাঁচটি খনিতে মোট কয়লার পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি মেট্রিক টন। দেশের অন্য খনিগুলোতে কয়লার অবস্থান যেখানে ১৫০ থেকে ৫০০ মিটার গভীরতার মধ্যে সেখানে জামালগঞ্জে কয়লার অবস্থান ৬৪০ থেকে এক হাজার ১৫৮ মিটার গভীরে। এই কারণে প্রচলিত সুরঙ্গ কিংবা উন্মুক্ত পদ্ধতির কোনোটিই এই খনি থেকে কয়লা তোলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ এর একটি পদ্ধতিতেও এত গভীর থেকে কয়লা তোলা কারিগরি ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়। তাই সেখানে সিবিএম প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।