খোলা বাজার২৪,শুক্রবার, ২২ এপ্রিল ২০১৬: সাভারে রানা প্লাজা নামে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবনধসের ঘটনার তিন বছর পার হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ এই শিল্প দুর্ঘটনায় পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে হত্যা মামলা করা হয় ওই ভবনের মালিক ও বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তদন্ত শেষ হয়েছে বহুদিন হলো। কিন্তু এখনো শুরুই হয়নি মামলার বিচারকাজ। একই অবস্থা ইমারতবিধি না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাটিরও।
গত মার্চে দুটি মামলার বিচারকাজ নিষ্পত্তি করতে বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ বছরই বিচারকাজ নিষ্পত্তি হতে পারে বলে
রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে। দুটি মামলায় আসামি উপস্থিতির জন্য দিন ধার্য রয়েছে ২৮ এপ্রিল। ওই দিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, সে বিষয়ে শুনানির জন্য নতুন দিন ঠিক করা হবে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভার বাজারে রানা প্লাজা ধসে পড়লে ১ হাজার ১৩৬ জন প্রাণ হারান। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন পোশাকশ্রমিক। ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছেন।
দুটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয় গত বছরের ১ জুন। মামলা দুটির ১২ জন আসামি পলাতক আছেন। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও প্রজ্ঞাপন জারি করতে প্রায় ১১ মাস চলে গেছে।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, বিচারের কাজে এ দীর্ঘসূত্রতা বিচারহীনতার নামান্তর। ওই দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। অবহেলার কারণে, অনিয়মের কারণে বহু মানুষের প্রাণ গেল। এটা তো ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু এখন এমন একটি অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেন কিছুই হয়নি। তিনি বলেন, ‘এই ভাবলেশহীন মনোভাবের কারণ বোধকরি এটাই যে, যারা অপরাধী তারা মালিক পক্ষ এবং ধনী। আর যারা মারা গেছে তারা অসহায়, দরিদ্র। প্রশ্ন হলো, এই রাষ্ট্র কি ধনীদের পক্ষে থাকবে?
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তকালে ও অভিযোগপত্র দেওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তাদের আসামি করতে আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে মতামত চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মতামত পেতে অনেকটা সময় পার হয়েছে।
আবদুল মান্নান বলেন, অনুমোদন না দেওয়ার পরও সরকারি চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা যায় কি না, তা আদালত দেখবেন। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের আসামি করার অনুমতি না মিললেও আদালত অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক চললে এ বছরই বিচারকাজ নিষ্পত্তি করতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এ ঘটনায় ডান পা হারানো গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার পুর্ব দামোদরপুর গ্রামের সোনিয়া বেগম (২১) আক্ষেপ করে বলেন, পা হারিয়ে কষ্ট করে চলছি। কিন্তু যাদের কারণে পঙ্গু হলাম, তাদের বিচার এখনো দেখতে পারলাম না। তিনি বলেন, ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে এ ধরণের ঘটনা আর দেখতে না হয়।
একই জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতগিরি গ্রামের লাভলী বেগম (২৪) বলেন, পা হারিয়ে ক্রাচে ভর দিয়ে চলছি। এই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার দেখে যেতে পারলে শান্তি পেতাম।
দুই মামলায় ওই ভবনের মালিকের ছেলে সোহেল রানাসহ মোট ৪২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়। ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে থাকায় দুই মামলায় মোট আসামি ৪২ জন। ইমারত আইনের মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন টঙ্গীর শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্র (আইআরআই) প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। তিনি অবসরে যাওয়ায় তাঁর বিষয়ে অনুমতি চাওয়া হয়নি।
মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, হত্যা মামলায় সরকারি চার কর্মকর্তাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই চার কর্মকর্তা হলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দপ্তরের পরিদর্শক (প্রকৌশল) ইউসুফ আলী, উপ-প্রধান পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম, ঢাকা বিভাগীয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান দপ্তরের যুগ্ম শ্রম পরিচালক জামসেদুর রহমান এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ইমারত পরিদর্শক আওলাদ হোসেন। এর মধ্যে ইউসুফ আলী ও শহিদুল ইসলাম নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। এই মামলার প্রধান আসামি সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ মোট ২৩ জন জামিনে আছে। আর সোহেল রানা, সরকারি কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন ও জামসেদুর রহমানসহ ছয়জন কারাগারে আটক আছেন।
আসামিদের জামিনের বিষয়ে পিপি জানান, দুটি মামলায় আসামিরা হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন। রানাকেও জামিন দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে তাঁর জামিন আদেশ স্থগিত করা হয়।
পলাতক আসামিরা হলেন সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, পৌর নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, বেলায়েত হোসেন, ঠিকাদার নান্টু, ইতার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস এবং আবদুল মজিদ, শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, মনোয়ার হোসেন, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম, আবদুল হামিদ ও নয়ন মিয়া।