খোলা বাজার২৪,শুক্রবার, ২২ এপ্রিল ২০১৬: ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল ব্রিটিশরা। তাদের শাসনের পরিধি এত ব্যাপক ছিল যে, প্রবাদই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, দব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায় না।দ
স্বাভাবিকভাবেই এ বিশাল সাম্রাজ্যের প্রজাদের কাছে মর্যদার আসন পেতেন রাজা বা রানিরা। উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজা-রানির আমল শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তবু এখনো রানি শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে ব্রিটিশ রানিদের কথা।
সিংহাসনে থাকার মেয়াদে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যেহেতু ছাড়িয়ে গেছেন রানি ভিক্টোরিয়াকে সেহেতু কে কার চেয়ে এগিয়ে এমন একটা জরিপ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নামি গণমাধ্যমে উভয়ের শাসনামলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করছেন। ‘রানি ভিক্টোরিয়া বনাম দ্বিতীয় এলিজাবেথ : কে কার চেয়ে এগিয়ে?’
১৮১৯ সালের ২৪ মে রানি ভিক্টোরিয়া জন্মগ্রহণ করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে- শিশু ভিক্টোরিয়ার মাতৃভাষা ইংরেজি ছিল না। তার মা ছিলেন একজন জার্মান ডিউকের মেয়ে, যিনি ইংরেজিতে কথা বলতেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন রানি ভিক্টোরিয়া। তার শাসনামলেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত হয় সবচেয়ে বেশি। ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসে তার সময়ে।
শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয় – কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড ও আফ্রিকা মহাদেশের বিশাল অংশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে আসে রানি ভিক্টোরিয়ার শাসনামলে। এই বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনভার তার হাতে থাকায় তিনি রানি থেকে হয়ে ওঠেন মহারানি।
সাম্রাজ্য বিস্তারে রানি সিদ্ধহস্ত হলেও নানা কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি নিজ দেশ ইংল্যান্ডে ছিলেন বিতর্কিত। এমনিতেই ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যাধিক ‘উত্তেজিত, স্বার্থপর, পক্ষপাতদুষ্ট, বাচাল এবং অলস’।
সিংহাসনে থাকাকালীন তিনি বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। অল্প বয়সে রানি মনোনিত হওয়ার পর তাকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতেন প্রধানমন্ত্রী লর্ড মেলবোর্ন। তারা বেশ ভালো বন্ধুও ছিলেন। ১৮৩৯ সালে তাদের এই বন্ধুত্বে ফাঁটল ধরে। এই বিরোধের জের ধরে লর্ড মেলবোর্ন ১৮৪১ সালে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান।
প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্লাডস্টোনের সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়ার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছিল। রানির তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৮৭২ সালে সিক্রেট বালট অ্যাক্ট এবং ১৮৮৪ সালে রিফর্ম অ্যাক্ট পাস হয়েছিল ইংল্যান্ডে। দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও রানি ও প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোনের সঙ্গে তীব্র বিরোধ ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে প্রেমের গুজব ও রাজকর্মচারী লেডি ফ্লোরাকে অন্তঃসত্তা বলে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া রানিকে ইংল্যান্ডে চরম অজনপ্রিয় করে তোলে।
লেডি ফ্লোরার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে মিথ্যা অপবাদ রটানোয় ইংল্যান্ডবাসী চরমভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে। এরই জের ধরে ইংল্যান্ডের রাস্তায় রানি প্রথমবারের মতো আততায়ীর হামলার শিকার হন। প্রকৃতপক্ষে মহারানি ভিক্টোরিয়া তার সাম্রাজ্য বিস্তারে ইংল্যান্ডে যতটা জনপ্রিয় ছিলেন ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ততটাই অজনপ্রিয় ছিলেন।
অন্যদিকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন ২৫ বছর বয়সে। নামের সঙ্গে দ্বিতীয় থাকলেও তিনি অদ্বিতীয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়েছেনে। এক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছেন রানি ভিক্টোরিয়াকে। ২৫ বছর বয়সে রানি এলিজাবেথের মাথায় ওঠে রাজমুকুট। সেই থেকে ইংল্যান্ডের জনগণের হৃদয়ে ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় রানি হয়ে কাটিয়ে দিলেন ৬৪ বছর ২ মাস ১৫ দিন।
ব্রিটিশ শাসন ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্রাজ্ঞী হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত আছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সাম্প্রতিক সময়ে দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের প্রতি ১০ জনের সাতজন রানিকে সমর্থন করেন। তারা রানির কাজকর্মে সন্তুষ্ট।
১৯৫২ সালের ৬ ফেব্র“য়ারি রানি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার মাধ্যমে দ্বিতীয় এলিজাবেথ কাজ করেছেন ১২ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, যাদের অনেকের জন্ম হয়েছে তিনি সিংহাসনে বসার পরে। দীর্ঘ এ শাসনামলে তিনি দেখেছেন নিজ দেশ ও বিশ্বের নানামুখী পট পরিবর্তন। কিন্তু প্রতিটি পট পরিবর্তনে তিনি দক্ষ হাতে তার সাম্রাজ্য শাসন করেছেন।
রানি ভিক্টোরিয়ার সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন বাড়লেও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময় তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। তবু নিজ গুণের কারণে তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর রানি হিসেবেই অধিষ্ঠিত আছেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আজ ২১ এপ্রিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৯০ বছরে পা দিলেন। দীর্ঘ এই সাড়ে ছয় দশকের শাসনকালে কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য বিতর্ক তাকে ছুঁতে পারেননি। তিনি কখনো কোনো কাজে আপোশ করেননি। কখনো নিজের ওপর আস্থা হারননি। এখনো তিনি শাসন কাজে সহজ ও সাবলীল।
দুই রানির মধ্যে এত এত তুলনা, আলোচনা- সমালোচনা থাকা সত্ত্বে দি টেলিগ্রাফ পত্রিকা মনে করে, উভয় রানিই ব্রিটিশদের পরম পূঁজনীয় ব্যক্তিত্ব। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে ব্রিটিশরা প্রাপ্য সম্নান দেয়, তেমনি মহারানি ভিক্টোরিয়া বিতর্কিত হলেও ইংল্যান্ডবাসী তাকে তার সম্নান দিতে কখনো কার্পণ্য করেনি।