খোলা বাজার২৪,শুক্রবার, ২২ এপ্রিল ২০১৬: প্রথম দুই ধাপের গোলযোগ-সহিংসতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘শক্ত অবস্থানে’ তৃতীয় ধাপে ৬২০ ইউনিয়ন পরিষদের ভোট সুন্দরভাবে হওয়ার প্রত্যাশায় আছে নির্বাচন কমিশন।
ছয় ধাপের ভোটের মাঝপথে দাঁড়িয়ে শনিবারের এই ভোটকে কেন্দ্র করে গোলযোগ ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের ‘বাড়াবাড়ি’ বন্ধ করতে বলেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি।
দলীয় এ নির্বাচনকে ঘিরে দেড় ডজন দল ভোটে থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা রোধে ইসিকে কঠোর হতে বলছে। বিএনপি দাবি করছে, ইসির ‘নিশ্চুপ’ ভূমিকায় সহিংসতা ঠেকানো যাচ্ছে না।
এমন সমালোচনার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করে সহিংসতা দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও তাগিদ দিয়েছে ইসি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ইউপি নির্বাচন সব সময় ঝামেলাপূর্ণ। দলীয় কোন্দলের জেরে ও নির্বাচন নিয়ে সহিংসতা হয়ে থাকে। এটা এড়াতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ভোটের অনিয়ম ঠেকাতে প্রয়োজনে কঠোর হতে ‘প্রধানমন্ত্রীর বার্তা’ পেয়ে ও বিশৃঙ্খলায় জড়ালে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে ‘সুন্দর’ নির্বাচনের প্রতীক্ষায় রয়েছে ইসি।
সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশনা রয়েছে- নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম, ত্রুটি, বিচ্যুতি উনি দেখতে চান না। অনিয়ম হলেই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। কোথাও কোনো অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে দলীয়ভাবেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে ইসির সমালোচনা করে বলেন, তাণ্ডব ও প্রাণহানি ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ তো করছেই না, উল্টো সরকারি রক্তাক্ত আক্রমণকে আশকারা দিচ্ছে।
গত ১১ ফেব্র“য়ারি ইউপি ভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত গোলযোগ-সহিংসতায় অন্তত ৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
‘শক্ত’ অবস্থানে ‘সুন্দরের’ প্রত্যাশায়
বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, “ইউপি নির্বাচন একটা বিশাল নির্বাচন। তৃতীয় ধাপের ভোট হবে শনিবার। ইতোমধ্যে কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে সজাগ রয়েছি, সতর্ক থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছি।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পরবর্তী ধাপগুলো ‘শক্তভাবে’ দেখবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, গত দুই ধাপের চেয়ে শক্ত অবস্থানে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আপনারা নির্বিঘেœ, নির্ভয়ে এসে নিঃসংকোচে ভোট দিয়ে যান। ভোটকেন্দ্রে আসতে কেউ বাধা দিলেই ব্যবস্থা নেব।”
প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের চেয়ে তৃতীয় ধাপে সুন্দর ভোটের প্রত্যাশায় আছে ইসি।
শাহনেওয়াজ বলেন, “অনিয়মের কারণে প্রথম ধাপে ৬৫টি কেন্দ্র ও দ্বিতীয় ধাপে ৩৭টি কেন্দ্র বন্ধ করেছি। দ্বিতীয় ধাপের ভোটের দিনও মারামারি কম হয়েছে। উত্তরোত্তর নির্বাচনী পরিবেশ ভালো হচ্ছে। আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের।”
এবার আইনশৃঙ্খলায় বাড়তি ব্যবস্থা থাকছে না জানিয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা রেখেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বাড়তি কোনো কিছু করা হচ্ছে না। অনিয়ম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনে সবাই সজাগ থাকবে। দুই ধাপ থেকে শিক্ষা নিয়ে আগেই খোঁজ খবর রেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কোনো দল বা বিশেষ ব্যক্তি বিবেচনায় না রেখে অনিয়মে জড়িত যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রচার শেষ, ভোটের অপেক্ষা
দেশের ৪৮ জেলার ৬২০ ইউপিতে এই ভোটের প্রার্থীদের সব ধরনের প্রচার শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে। শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট চলবে এসব এলাকায়।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ-সচিব সামসুল আলম জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে রয়েছে, নির্বাচনী সামগ্রী শুক্রবার বিকালের মধ্যে সব কেন্দ্রে যাবে। পাবর্ত্য এলাকায় হেলিকপ্টারে যাবে নির্বাচনী মালামাল।
সুষ্ঠু ভোটের জন্য সঠিক অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে গাজীপুরে একজন এসপি ও দুইজন ওসিকে এবং গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তৃতীয় ধাপের ভোট তথ্য
তৃতীয় ধাপে ২৩ এপ্রিল ভোটের জন্য ৬৮৫টি ইউপির তালিকা করেছিল ইসি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সব প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের ৫৩ ইউপির ভোট ষষ্ঠ ধাপে নেওয়া হয়েছে। নানা জটিলতায় আরও একডজন ইউপির ভোটও পরের ধাপে গেছে।
শনিবার ৬২০ ইউপিতে ভোট হওয়ার কথা। আদালতের আদেশে কোনো স্থগিতাদেশ এলে এ সংখ্যা কমতে পারে বলে জানান ইসির জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান।
এ ধাপে চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছে ২ হাজার ৬৭২ জন। সাধারণ সদস্য পদে ২০ হাজার ৯৪৩ জন ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬ হাজার ২৯৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছে।
ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ২৫ জন, সাধারণ সদস্য পদে ১৭৪ জন ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৭৯ জন নির্বাচিত হয়েছেন।
এসব ইউপিতে মোট ভোটার ১ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৫৫ জন। ভোটের দিন সাড়ে ছয় হাজারের বেশি কেন্দ্রে লক্ষাধিক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেড় লাখের মতো সদস্য নিয়োজিত থাকবে।
তৃতীয় পর্বে প্রার্থী ও দল
তৃতীয় ধাপের ভোটে চেয়ারম্যান পদে মোট ১৪টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রয়েছে ১ হাজার ৪৮৭ জন এবং স্বতন্ত্র ১ হাজার ১৮৫ জন।
দলীয় প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৬২০ জন, বিএনপির ৫৩৯ জন, জাতীয় পার্টির ১৬৭ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের ২৬ জন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ১২ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ৯২ জন, জাতীয় পার্টি- জেপির ৩ জন, খেলাফত মজলিসের ২ জন, বিকল্পধারার ৩ জন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ৫ জন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ১০ জন, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের ৩ জন এবং বাসদের ১ জন ও অন্যান্য দলের ৪ জন।
দুই পর্বের ফল
প্রথমবারের মতো দলভিত্তিক এই ইউপি নির্বাচনে অন্তত দেড় ডজন দল অংশ নিলেও মূল লড়াই চলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে।
গত ২২ মার্চ প্রথম ধাপে ৭১২ ইউপির ও দ্বিতীয় ধাপে ৩১ মার্চ ৬৩৯ ইউপির ভোট হয়। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ ১০০১ ইউপিতে ও বিএনপি ১০৮ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদ পেয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছে ২১৮ ইউপিতে।
প্রথম ধাপে ৭৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং দ্বিতীয় ধাপে পড়েছে ৭৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
ছয় ধাপের ভোটের জন্য ১১ ফেব্র“য়ারি প্রথম ধাপের তফসিল ঘোষণা হয়। ৪ জুন হবে ষষ্ঠ ধাপের ভোট।