Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

4খোলা বাজার২৪,বুধবার, ৪ মে ২০১৬: সিঙ্গাপুর থেকে এর আগেও কয়েক দফায় ২৭ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকে জঙ্গিবাদে যুক্ত কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সিঙ্গাপুর সরকার তাঁদের ফেরত পাঠিয়েছিল। চার মাসেও পুলিশ সন্ত্রাস দমন আইনে করা এ মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি।
সিঙ্গাপুরে নির্মাণ খাত, লিফট মেরামত, বাগান করা, ঝালাই করা ইত্যাদি কাজে যুক্ত এই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছিল, এঁরা নিয়মিত পাঠচক্রে মিলিত হতেন। তাঁরা আনওয়ার আল আওলাকি প্রচারিত উগ্রপন্থী বিশ্বাস ও মৌলবাদী ধ্যানধারণার চর্চা করতেন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদা এবং ইরাক ও সিরিয়ার ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জিহাদের প্রতিও তাঁদের সমর্থন ছিল। তাঁদের কাছ থেকে সিঙ্গাপুরের পুলিশ ভিডিও ক্লিপ ও কিছু তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে। ক্লিপটিতে শিশুদের জিহাদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার দৃশ্য ধারণ করা আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে ২৬ জন ও পরে একজনকে সিঙ্গাপুর সরকার বাংলাদেশে পাঠায়। এঁদের মধ্যে ১২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁরা নজরদারিতে আছেন। বাকিদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে।’ ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, অগ্রগতি সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানো হয়েছে। তারা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, আটক শ্রমিকদের মধ্যে অন্তত তিনজন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন কুমিল্লার নুরুল আমিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডলার পারভেজ ও মুন্সিগঞ্জের মো. জসিম। এই তিনজনই আট-নয় বছর ধরে সিঙ্গাপুরে ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দুই ব্যক্তি সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করতেন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দিন রাহমানির বয়ান শোনাতেন ও নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করতেন। এই দুই ব্যক্তির বাড়ি টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জে হলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত তাঁদের নাম জানতে পারেনি। তাঁরা বিভিন্ন সময় নিজেদের বিভিন্ন নামে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা অন্যদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) এক কর্মকর্তা বলেন, উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হলেও ফেরত পাঠানো শ্রমিকদের কেউ দেশের ভেতর নাশকতামূলক কিছু করার পরিকল্পনা করছিলেন বলে জানা যায়নি। দেশে থাকতে তাঁদের কেউই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর এই শ্রমিকদের কারও কারও মধ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ও জীবনাচরণে পার্থক্য দেখা দেয়। বিভিন্ন দেশে চলা চরমপন্থী আন্দোলনের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। এই প্রবাসীরা ‘লা-মাজহাব’ নামে একটি দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ বলেন, ‘মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ধর্মীয় রীতি, আচার-অনুষ্ঠানে চার ধরনের মাজহাব অনুসরণ করতে শুরু করেন। লা-মাজহাব মানে যাঁরা কোনো মাজহাবকেই অনুসরণ করেন না। এঁরা উগ্রপন্থী। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মীয় সম্প্রীতির মূল কারণ এখানকার মানুষ উদারনৈতিক হানাফি মাজহাবের অনুসারী। কিন্তু আজকাল এখানেও কেউ কেউ “লা-মাজহাব”-এর পক্ষে কথা বলছেন।
কারাগারে থাকা আটক দু-তিনজন ব্যক্তির আচার-আচরণে আকস্মিক পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেছেন দেশে তাঁদের আত্মীয়স্বজনও। আটক ডলার পারভেজের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাঁপাই মহেশপুর গ্রামে। ওই গ্রামে তাঁর প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ডলার দেশে এলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার পদ্ধতির ভুলত্রুটি ধরতেন এবং এগুলো শুধরানোর কথা বলতেন।
আটক ১৫ জনের মধ্যে তিনজনের বাড়ি টাঙ্গাইলে। দুজন টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার দুটি গ্রামে বসবাস করেন। দাপানজোড় গ্রামের আমিনুর সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর বলেন, তিনি মাজহাব পরিবর্তন করেছেন। আর মটরা গ্রামের আবদুল আলীম পারিবারিকভাবেই আহলে হাদিস গোষ্ঠীর।
আটক ব্যক্তিদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম ঢাকার উত্তরখানের কাঁচকুড়া বড়বাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর স্ত্রী তামান্না আক্তার বলেন, সাইফুল ও তাঁর ভাই সিঙ্গাপুরে একই প্রতিষ্ঠানে লিফট মেরামতের কাজ করতেন। সিঙ্গাপুর থেকে ছুটিতে কাঁচকুড়ায় এলেও সাইফুল এলাকার লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করতেন না। তবে স্থানীয় মসজিদে সবার সঙ্গে নামাজ পড়তেন। তাঁর আচরণেও কেউ কোনো অস্বাভাবিকতা দেখেননি। কাঁচকুড়া ও এর আশপাশের দু-এক গ্রামের বহু মানুষ এখন সিঙ্গাপুরে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। সিঙ্গাপুর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন।
আটক থাকা কয়েকজন আসামির আচার-আচরণে পরিবর্তন হলেও স্বজনদের দাবি, এঁদের কেউই সক্রিয়ভাবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েননি। আর পুলিশ বলছে, ভালোভাবে খতিয়ে দেখে তবেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। এখনো কাজ চলছে।