খোলা বাজার২৪, বুধবার, ১১ মে ২০১৬: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
সিলিকন ভ্যালির সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ফায়ারআই-এর তদন্তে এ তথ্য মিলেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে আলোচিত এই সাইবার হামলার ঘটনায় ফায়ারআই-এর তদন্তকারীরা তিনটি হ্যাকার গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছেন।
ফায়ারআই-এর দুজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই চুরিতে জড়িত তিনটি হ্যাকার গ্রুপের মধ্যে একটি পাকিস্তানের ও অন্যটি উত্তর কোরিয়ার বলে ফরেনসিক পরীক্ষায় তারা তথ্য পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ফেব্র“য়ারির শুরুতে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার সরানোর চেষ্টা হয়। এর মধ্যে চারটি ভুয়া বার্তার মাধ্যমে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরশনে (আরসিবিসি) সরিয়ে নেওয়া হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। আরেকটি ভুয়া বার্তার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার একটি এনজিওর নামে ২ কোটি ডলার পাঠানো হলেও বানান ভুলের কারণে তা আটকে যায়।
রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের ঘটনাটি দেশে জানাজানি হয় মার্চের প্রথম সপ্তাহে। এরপর ফায়ারআইকে ফরেনসিক তদন্তের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ভারতীয় প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।
তবে তৃতীয় হ্যাকার গ্রুপটি কারা ও কোন দেশের, তা এখনও নিশ্চিত হতে না পারলেও, ওই গ্রুপটিই চুরির অর্থ সরাতে মূল ভূমিকা পালন করেছে বলে ব্লুমবার্গকে জানিয়েছেন ফায়ারআই-এর তদন্তকারীরা।
রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন; অব্যাহতি দেয়া হয় দুজন ডেপুটি গভর্নরকেও। একই দিন রাজধানীর মতিঝিল থানায় একটি মামলার পর তদন্তে নামে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এরইমধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে দুই কোটি ডলার ফেরত পাওয়া গেছে। তবে ফিলিপাইনে যাওয়া অর্থ এখনও ফেরত পাওয়া যায়নি।
এছাড়া এই চুরির ঘটনার তদন্তে সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে করা হয় তিন সদস্যের কমিটি। কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্র্বতী প্রতিবেদন ও ৭৫ দিনে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এরইমধ্যে অন্তর্র্বতী প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা পড়েছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অজানা তৃতীয় পক্ষটি কোনো সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক কিংবা কোনো দেশের এজেন্ট কি-না, তা বোঝার জন্য যথেষ্ট তথ্য পায়নি ফায়ারআই। আর ওই পক্ষটিও প্রকৃত অপরাধী হতে পারে।
তবে ফায়ারআইয়ের মুখপাত্র ভিক্টর ডি সুজা এ বিষয়ে ব্লুমবার্গের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এর আগে গত রোববার বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দেশের গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানায়, সুইফট টেকনিশিয়ানদের অবহেলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্ভার অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল।
এরপর নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সুইফট দাবি করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তাদের নয়, বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেরই সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবহারকারী অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতোই পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ সব ব্যাংকিং পদ্ধতির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকেরই ছিল বলেও ব্রাসেলসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সুইফটের ওই বিবৃতিতে বলা হয়।
এরমধ্যেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আইয়ের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে মঙ্গলবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, রিজার্ভ চুরির এই ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরকার কেউ সহায়তা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওই এফবি আই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত একজন কর্মকর্তা এতে জড়িত বলে তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। অন্য কয়েকজন হতে পারে সহায়তাকারী।’
এদিকে, রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলে মঙ্গলবার রাতে এক বৈঠকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক (নিউইয়র্ক ফেড), সুইফট কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।
ওই বৈঠকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ডাডলি ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও সুইফট প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে নিউইয়র্ক ফেডের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বৈঠকে উপস্থিত সব পক্ষই রিজার্ভের অর্থ চুরি ও অর্থ উদ্ধার—এ দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার ও অন্যান্য কাঠামোগত নিরাপত্তার ত্রুটি নিয়ে আলোচনা হয়।
রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিংয়ের বিষয়ে কথা বলতে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলেও প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। এছাড়া জাতিসংঘে উত্তর কোরিয়া মিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোন ও ইমেইলে যোগাযোগ করলে তারাও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি বলে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে।