খোলা বাজার২৪, রোববার, ১৫ মে ২০১৬: সুইমিং পুলে পার্টি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এসেছিলেন ৫০ নারী মডেল ও ৩০ জন পুরুষ। এর মধ্যে রোয়ান ব্রিউয়ার নামে এক মডেলের প্রতি আকৃষ্ট হন ট্রাম্প। প্রথম পরিচয়েই সবার কাছ থেকে আলাদা করে নিজের বিলাসবহুল বাড়ি দেখান তাঁকে। ক্ষণিকের পরিচয়েই ব্রিউয়ারকে পোশাক বদলে সাঁতারের পোশাক পরতে বাধ্য করেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লিখিত ঘটনা নারীদের প্রতি ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাবের কিছুটা প্রকাশ পায়। ঘটনার সময় ব্রিউয়ারের বয়স ছিল ২৬। ওই সময় ৪৪ বছর বয়সী ট্রাম্পের প্রথম বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছিল।
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত। মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করে এরই মধ্যে বিতর্কিত হয়েছেন তিনি। স্মরণকালের ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী নিয়ে এতটা বিতর্ক দেখা যায়নি।
মার্কিন মুলুকে কয়েক দশক ধরেই পরিচিত ট্রাম্প। রিয়াল এস্টেট, ক্যাসিনো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায় দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত ট্রাম্প। একই সঙ্গে তিনি মিডিয়া ব্যক্তিত্বও। সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজক এই ট্রাম্প।
কর্মসূত্রে বা অন্য কোনো সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছাকাছি ছিলেন এমন ৫০ মডেল ও সহকর্মীর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। অর্ধশতাধিক সাক্ষাৎকার নিয়ে করা এই প্রতিবেদনে ট্রাম্প সম্পর্কে নারীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকের প্রতিক্রিয়াই নেতিবাচক। নারীদের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করা, লোক দেখানো বিষয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন দোষের কথা বলেন তাঁরা। আবার কিছু নারী ট্রাম্পকে তাঁদের ক্যারিয়ার গড়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ দেন। ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্যকেও গুরুতর বলে মানতে নারাজ তাঁরা।
সাক্ষাৎকার, আদালতের নথি ও লিখিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নারীদের বিষয়ে ব্যক্তিগত আগ্রহ প্রকাশ, জনসমক্ষে কোনো নারীর শরীর নিয়ে বিরূপ মন্তব্য, কর্মক্ষেত্রেই নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে।
সুন্দরীদের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ
সুন্দরীদের প্রতি ট্রাম্পের আকৃষ্ট হতে দেখা যায় ছোটবেলা থেকেই। নিউইয়র্ক মিলিটারি অ্যাকাডেমি নামক এক বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে মেয়েবন্ধু নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ অনুষ্ঠানে মেয়েবন্ধু যেতে পারত। ১৯৬৪ সালে ট্রাম্পের সহপাঠী ছিলেন জর্জ হোয়াইট। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতি বিশেষ দিনেই সমবয়সী মেয়েবন্ধুকে স্কুলে নিয়ে যেতেন ট্রাম্প। প্রতিবারই নতুন বন্ধু। সহপাঠীদের কাছে এই বন্ধুদের দেখানোই ছিল ট্রাম্পের মূল উদ্দেশ্য। ছোট বয়সেই ‘লেডিসম্যান’ উপাধি পান তিনি।
সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব
ছোট বা বড় যে সিদ্ধান্তই হোক, নারীদের কাছে নিজের মতামতই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এই স্বভাব বাবা ফ্রেড ট্রাম্পের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে মনে করেন ডোনাল্ডের দ্বিতীয় ও বর্তমান স্ত্রী ইভানা জেলনিকোভা ট্রাম্প। ১৯৭০ সালে ট্রাম্পের একটি রেস্টুরেন্টে ট্রাম্পের পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবারে যোগ দেন তিনি। ওই সময়ই তিনি খাবার বেছে নেওয়ায় ট্রাম্পের চাপিয়ে দেওয়া মনোভাবের পরিচয় পান। ট্রাম্পের ওপর তাঁর বাবার প্রভাব দেখেন। নিজের মা-বাবাকে রোল মডেল হিসেবেই উপস্থাপন করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে প্রতিষ্ঠানে নারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বাবার মতের বাইরে যান তিনি।
সুন্দরী প্রতিযোগিতায় ট্রাম্পের বিরূপ আচরণ
মিস ইউনিভার্স প্রতিষ্ঠান কিনে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। ১৯৯৭ সালের বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া টেম্পল ট্যাগার্ট বলেন, লাইনে দাঁড় করিয়ে বিশ্বসুন্দরীদের খুব কাছ থেকে দেখতেন ট্রাম্প। এবং বিভিন্ন জন সম্পর্কে বিভিন্ন মন্তব্য করতেন। এ ছাড়া সব প্রতিযোগীরই ঠোঁটে চুমো দেওয়ার প্রবণতা ছিল ট্রাম্পের। বিষয়টি অধিকাংশ প্রতিযোগীই ভালোভাবে নেননি।
২০০৯ সালে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ক্যারি প্রেজিয়ান বলেন, বিভিন্ন প্রতিযোগীকে বিরূপ প্রশ্ন করে তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন ট্রাম্প।
নারীদের শরীর নিয়ে বিরূপ মন্তব্য
ট্রাম্পের দাবি, কর্মজীবনে নারীদের সম্মানের সঙ্গে দেখেছেন। তাঁর সংস্পর্শে আসা সব নারীই এ কথাই জানাবেন। তবে রোজি ও’ডনেল কিন্তু ভিন্ন কথা বলেন। ট্রাম্পের হয়ে কাজ করেন এই মার্কিন টেলিভিশন তারকা ও কৌতুক অভিনেত্রী। এক সাক্ষাৎকারে এই রোজিকেই ‘কুৎসিত মোটামুখো’ মন্তব্য করেন ট্রাম্প। ৫৪ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্পবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কর্মক্ষেত্রেও নারীদের শারীরিক গঠনের কথা তুলে বিভিন্ন মন্তব্য করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একবার ওজন বেড়ে যাওয়া এক নারী নির্বাহীকে তিনি বলেন, ‘তুমি চকলেট পছন্দ করো।’ অপর এক কর্মীকে ওজন কমালে সুন্দর লাগবে বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প। নিজের প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা কতটা সুন্দর অন্যদের কাছে এটি দেখানোর স্বভাব ট্রাম্পের।
নিজের পরিবারের সদস্যদের সৌন্দর্য নিয়েও অন্যের কাছ থেকে মন্তব্য চাইতেন ট্রাম্প। ১৯৯৭ সালে ‘মিস ইউনিভার্স ইউএসএ টিন’ অনুষ্ঠানে নিজের মেয়ে ইভানকার শারীরিক গঠন সম্পর্কে তৎকালীন বিশ্বসুন্দরী ব্র“ক লির কাছে জানতে চান। এমনকি এক থেকে ১০-এর মধ্যে নম্বরও দিতে বলেন তাঁকে।
নারীদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলে বেড়ানো
সুন্দরী নারীদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলে বেড়ানো পছন্দ করেন ট্রাম্প। ১৯৯০ সালে নিউইয়র্কের এক ডেপুটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ট্রাম্প। ওই মেয়রকে তিনি বলেন, ‘ভিক্টোরিয়াস সিক্রেটে’র (নারীদের অন্তর্বাস প্রস্তুতকারক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান) এক মডেলের সঙ্গে তাঁর ‘ডেট’ আছে। এভাবে সুন্দরী মেয়েদের সম্পর্কের কথা সবাইকেই জানাতে চাইতেন ট্রাম্প। নিজের সহকর্মীদের কাছেও মেয়েবন্ধু বা স্ত্রী কতটা সুন্দর তা জানাতেন ট্রাম্প।
নারীদের বিশ্বস্ত সহকর্মী বলেন ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নারী নির্বাহী বারবারা এ রেস বলেন, নারীদের বিশ্বস্ত সহকর্মী বলে মনে করেন ট্রাম্প। একবার ট্রাম্প তাঁকে বলেন, একজন নারী ১০ পুরুষের চেয়ে ভালো। ট্রাম্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নারীদের রাখা হয়েছে। প্রথাগতভাবে যেসব কাজে পুরুষদের প্রাধান্য, সেখানেও নারীদের নিয়োগ দেন ট্রাম্প।
স্ত্রীকে সহকর্মী করে আক্ষেপ
স্ত্রী ইভানা ট্রাম্পকে নিজের কিছু ব্যবসার দায়িত্ব দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্যাসিনো ও হোটেলের দায়িত্ব নেন ইভানা। তবে পরে স্ত্রীকে এমন দায়িত্ব দিয়ে প্রকাশ্যে আক্ষেপ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, এই কারণে বাড়িতে হালকা কথার বদলে ব্যবসায়িক আলোচনাই বেশি চলে।
অভিযোগ ও অস্বীকার
প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের সময়ই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নারীর প্রতি বিরূপ আচরণের গুরুতর অভিযোগ ওঠে। ১৯৯৩ সালে সাংবাদিক হ্যারি হার্ট এক প্রতিবেদনে দাবি করেন, দ্বিতীয় স্ত্রী ইভানাকে যৌন নির্যাতন করেছেন ট্রাম্প। এ ছাড়া বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতাকালে হার্টের সঙ্গে বিরূপ আচরণের অভিযোগও পাওয়া যায়।
নারীদের প্রতি বিরূপ আচরণের অভিযোগের তথ্য ও সচিত্র প্রমাণ থাকলেও বরাবরই তা অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। তিনি দাবি করেন, বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তিনি নারীরের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। এই কারণে হাজারো নারী উপকৃত হয়েছে।