খোলা বাজার২৪, সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬: রোয়ানুর আঘাতে বিধ্বস্ত উপকূলের জনপদ। ভারি বর্ষণ ও জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে প্রত্যন্ত এলাকায়। ডুবে গেছে রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, আবাদি জমিত। ফলে পানিবন্দি অবস্থায় দিনপার করছেন দুর্গতরা।
কেবল এখানেই শেষ নয়। অনেক দুর্গত এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের তিনদিনেও পৌঁছায়নি ত্রাণ। কোনো কোনো এলাকায় যে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। একদিকে দুর্গত মানুষের কান্না-হাহাকার অন্যদিকে ভাসমান জনপদের বিবর্ণদশা।
বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে এখনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি। রোয়ানুর প্রভাবে প্লাবিত হয়েছে জেলার অধিকাংশ অঞ্চল। বরগুনার ৪৫ টি গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে জোয়ারের পানি ও অতি বৃষ্টিতে ১৯ মে পর্যন্ত ২ হাজার ৮৯৫ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলার মধ্যে ২ হাজার ৫৯৯ হেক্টর বীজতলা সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে গেছে। দ্রুত এসকল স্থানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হলে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী জোয়ারের চাপে বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা, সোনাতলা, ছোটবালীয়াতলী, ডালভাঙায়, তালতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাসিয়া তেঁতুলবাড়িয়া ও পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়ায় এলাকাসহ ১৮টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব পয়েন্টের ৭৮৫ মিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছয় কিলোমিটার। তবুও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এখনো পৌঁছায়নি কোনো ত্রাণ সহায়তা। তাই অনাহারে এখনো দিন কাটছে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবারের।
জেলা প্রশাসক ড. মুহা. বশিরুল আলম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তের বিষয়টি দৃশ্যমান না হওয়ায় তাৎক্ষণিক কোনো ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়নি। তবে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পরে সেখান থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।’
ৎড়ধহঁথনফহবংি২৪ঁংভোলাতে সরকার যৎসামান্য অর্থ সহায়তা করেছে দুর্গতদের মাঝে। তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। রোয়ানুর প্রভাবে জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সমগ্র উপজেলা জুড়ে পথে পথে ঝড়ের ক্ষতচিহ্ন। ঘর ভেঙে যাওয়ায় রান্নাও করতে পারছেন না দুর্গতরা। সম্বলহারা পরিবারগুলো আয়ের উৎস হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন। এদিকে, দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।
তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জালাল আহমেদ জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এদের মধ্যে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ১০ কেজি করে মোট ১০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
আর এ দিকে সরকারে এই যৎসামান্য অর্থ সহায়তায় সন্তুষ্ট নয় ক্ষতিগ্রস্তরা। তারা বলছে এই সামান্য অর্থে তাদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না।
এ সম্পর্কে তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘রোয়ানুর প্রভাবে আমার ঘরবাড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে গেছে। ঘরের মালামাল চাল, ডাল সব নষ্ট হয়েছে। ১০টি মুরগী ৬টি হাঁস ও একটি ছাগল মারা গেছে। কীভাবে কী করব জানি না। সরকারের কাছ থেকে যে সহায়তা পেয়েছি তা দিয়ে কিছুই করা যাবে না।’
শশীগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, ঝড়ে আমার সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সরকারিভাবে মাত্র ৫ কেজি চাল পেয়েছি। এতে আমার পরিবারের মাত্র একদিন চলবে।
ভোলা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে ৪ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের জন্য নগদ ৪ লাখ টাকা ও ৫০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বিতরণের কাজ চলছে।
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া উপজেলায় রোয়ানুর ক্ষতিগ্রস্তরা এখনোও দিন কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ গ্রামগুলো থেকে পানি নিষ্কাশন হলেও ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ায় এখনো ঘরে যেতে পারছেন না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত নগণ্য।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসনাত মো. মঈন উদ্দিন জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রাথমিকভাবে ১০ কেজি করে চাউল বিতরণ ও শুকনো খাবার চিড়া ও মুড়ি দেওয়া হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে আরো ১/২ দিন লাগবে বলেও তিনি জানান।
ৎড়ধহঁথনফহবংি২৪ঁং
পটুয়াখালীর ৮টি উপজেলায় ২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড। জেলার চর অঞ্চলের মানুষের জানমাল রক্ষার্থে এই বেড়িবাঁধগুলো রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করত।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জেলার গ্রামীণ এলাকার বেশ কিছু রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলার সড়ক ও জনপথ বিভাগের ক্ষতি সম্পর্কে নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘অতি বৃষ্টির কারণে বিক্ষিপ্ত ভাবে জেলার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করতে এক কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী, জেলার ৮টি উপজেলায় ১৩২২ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি, ১৯৬ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা ও ৪৬ হেক্টর জমির পান বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ৎড়ধহঁথনফহবংি২৪ঁংগত শনিবার ভোর থেকে রোয়ানু ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত আনে। এতে করে দেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। এ ছাড়া কয়েকটি জেলায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয়।