খোলা বাজার২৪, বুধবার, ২৫ মে, ২০১৬: আজ ২৫ মে। ২০০৯ সালের এই দিনে সাতক্ষীরায় আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। সে আঘাতে মারাত্মক ক্ষতির শিকার সাতক্ষীরার তিনটি ইউনিয়নের মানুষ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ হয়েছে, জনসম্পদ উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে লোকজন চলে যাচ্ছে অন্যত্র।
পানের পানির জন্য হাহাকার উঠেছে গাবুরা ও পদ্মপুকুরে। নোনা মাটি আর নোনা পানির এই জনপদ এখন বৃক্ষহীনতায় বিরান। এত দিনেও এসব এলাকার পরিবেশগত উন্নতি হয়নি। রেশনিংয়ের মাধ্যমে কিছু মানুষ খাবার পানি পেলেও অন্যদের অবস্থা করুণ। পুকুরের পানিই তাঁদের একমাত্র ভরসা।
২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দক্ষিণের এই জনপদ। উপকূলে প্রাণ হারান ১০৯ জন মানবসন্তান। এর মধ্যে কেবল গাবুরা ও পদ্মপুকুরেই মারা যান ৭৩ জন। ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয় নেন সড়ক কিংবা উঁচু স্থানে। এভাবে দুই বছর কাটানোর পর তাঁরা নতুন ঘর পেয়েছেন।
আইলার আঘাতে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার হলেও তা ঝুঁকিমুক্ত নয়। আইলার জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ায় বহু চেষ্টার পর বাঁধ নির্মাণ হলেও তার স্থায়িত্ব এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। মূল বাঁধ বাঁধতে ব্যর্থ হয়ে রিং বাঁধ নিয়ে গ্রামে পানি ঢোকা বন্ধ করা গেলেও তা কত দিন টিকে থাকবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
আইলাবিধ্বস্ত উপকূলে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের দাবি ছিল, ‘পরিকল্পিত বাঁধ চাই, জীবন-জীবিকা ও সম্পদের নিরাপত্তা চাই।’
আইলার আঘাতে বিপর্যস্ত শ্যামনগরের গাবুরা ,পদ্মপুকুর ও আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে এই আন্দোলন যতই তীব্র হয়েছে, ততই পানি উন্নয়ন বোর্ড মানুষকে আশ্বস্ত করেছে। এলাকার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থা বিবেচনা করে সর্বনিম্ন ২০ ফুট উঁচু, ১২০ ফুট তলা ও ৩০ ফুট মাথা রেখে বাঁধ নির্মাণের তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড জনগণের অভিজ্ঞতার মূল্য না দিয়ে কম উচ্চতার বাঁধ নির্মাণ শেষ করেছে। এতে নতুন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
আইলার মতো আরো একটি দুর্যোগ আঘাত করলে গাবুরা, পদ্মপুকুর ও প্রতাপনগরের মানুষ ফের ভেসে যাবে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশকে তৈরি বেড়িবাঁধের উচ্চতা ছিল ১৪ ফুট পর্যন্ত। সময়ের বিবর্তনে আইলা-পূর্বকালে ক্ষয়িত এই বাঁধের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল সাড়ে নয় ফুট।
২০০৯-এর ২৫ মে ভয়ংকর আইলায় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১৫ ফুট পর্যন্ত। এতে মুহূর্তের আঘাতেই সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পদ্মপুকুরের ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ১৮ কিলোমিটার। আংশিক বিধ্বস্ত হয় ১০ কিলোমিটার।
অন্যদিকে গাবুরার সাড়ে ২৮ কিলোমিটারের মধ্যে ১৫ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। আংশিক ক্ষতির শিকার হয় অবশিষ্ট এলাকা। এ ছাড়া আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের কয়েকটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ পানিতে একাকার হয়ে যায়। এ ইউনিয়নের ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। বিধ্বস্ত এসব বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলেও তা যেকোনো সময় ধসে যাওয়ার শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম ও পদ্মপুকুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম।
সাবেক দুই জনপ্রতিনিধি জানান, এ দুই ইউনিয়নের কাছে রয়েছে সমুদ্রঘনিষ্ঠ প্রমত্তা নদী। তার ওপর ভঙ্গুর বাঁধ। এর স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দিহান সব মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এ কারণে বেড়িবাঁধগুলো জলোচ্ছ্বাসে ধসে যায়। হাইকোর্টের এক রায়ে নোনা পানি ঢুকিয়ে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত করে চিংড়ি চাষ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।
গাবুরার বর্তমান চেয়ারম্যান আলী আজম টিটো বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বারবার ধ্বংস হচ্ছে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ও পদ্মপুকুর। জনবসতির অনুপযোগী হয়ে উঠছে দক্ষিণের এই দ্বীপ ইউনিয়নগুলো।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে উপকূলীয় এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের দক্ষিণ উপকূল পানিতে তলিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা যে শঙ্কা করেছেন, তাঁর সঙ্গে একমত স্থানীয়রা। তাঁদের ভাষ্য, জনগণের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। ২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যা এ অঞ্চলকে প্রথম বড় দুর্যোগের অভিজ্ঞতা দিয়েছে। এর আগে-পরে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সুপার সাইক্লোন, ১৯৮৫ সালের ২৫ মের হারিকেন, ১৯৮৮ সালে ২৯ নভেম্বরের হারিকেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের সুপার সাইক্লোন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মের ভয়ংকর আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মের মহাসেন এবং চলতি বছরের ২১ মের ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাত প্রমাণ করেছে, জলোচ্ছ্বাস দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলকে যেকোনো সময় গ্রাস করে ফেলতে পারে।
গাবুরার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শফিউল আজম লেনিন বলেন, কোনো এক সকালে যেন দেখতে না হয় গাবুরা আর পদ্মপুকুর সমুদ্রের পানির নিচে, যেমনটি ঘটেছে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের ভাগ্যে। এরই মধ্যে গাবুরা ও পদ্মপুকুরে কালবৈশাখীর তাণ্ডব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে বহু বাড়িঘর। এ দুটি ইউনিয়নের কয়েকটি বেড়িবাঁধও জোয়ারের পানির তোড়ে ভেঙে যায়।
আইলা উপদ্রুত মানুষের খাবার পানির জন্য খনন করা হয়েছে পুকুর। তাঁদের অনেকে ছয় মাস ধরে ব্যবহার করছেন বৃষ্টির পানি। নতুন করে চিংড়ি চাষ শুরু হলেও জমিতে কোনো ফসল হচ্ছে না। মাঠে ঘাস না জন্মানোয় গবাদি পশু পালন বন্ধ হয়ে গেছে। নদীতে পোনা ধরা নিষেধ থাকায় সংকট হয়েছে কর্মসংস্থানের। এখানে কাজ করে বেঁচে থাকার সব সুযোগবঞ্চিত মানুষ। অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা পাওয়ারও সুযোগ নেই।