খোলা বাজার২৪, বুধবার, ০১ জুন ২০১৬: আজ ১ জুন ২০১৬ ইং সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি কর্তৃক পবিত্র মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতির প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পার্টির মহাসচিব মহিউদ্দিন আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান এম.এ রশীদ প্রধান, ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হক, বাংলাদেশ ইসলামিক মুভমেন্ট এর চেয়ারম্যান এ্যাড. নুরুল ইসলাম খান সহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
পার্টির মহাসচিব মহিউদ্দিন আহমেদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, আমরা সকলেই অবগত আছি যে, সারা বিশ্বের মুসলিম জাহানের জন্য সিয়াম সাধনা ও সংযমের মাস এক পবিত্র রমজান মাস। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ আপনাদের সম্মুখে হাজির হয়েছি। যে দেশে প্রায় ৯২% মুসলমান বাস করে। যে দেশ একটি ইসলামিক রাষ্ট্র সে দেশেই রমজান মাস আসার পূর্বেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে দেখা যায় যে, যেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় সেখানে দ্রব্যের মূল্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বরাবরই হয় এর উল্টো। এদেশের সরকার ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো দুর্বলতার সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদার, ফরিয়াহ, টাউট ও মধ্যস্বত্তভোগী দালাল শ্রেণীর কারনে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি হয়। যার ফলে সাধারণ জনগোষ্ঠির জন্য রোজা রাখাও কষ্টকর হয়। যা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন।
রমজানে সাধারণত যে পণ্যগুলো বেশি প্রয়োজন হয় তাদের মধ্যে অন্যতম যেমন ১। ছোলা, ডাল, বেসন, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, তৈল, চিনি, মুড়ি, গড় মসলা।
২। মাছ, মাংস, ডিম, ও আমিষ জাতীয় খাদ্য।
৩। তরীতরকারির মধ্যে বেগুন, শসা, ধনিয়া পাতা, কাচা মরিচ ইত্যাদি।
৪। পানীয় জাতীয় খাবার। যেমন- দুধ, জুস ও তরল পানীয়।
৫। খেজুর ও দেশীয় ফলমূল।
আমরা প্রথমত ছোলার কথায় যদি আসি তাহলে দেখবো আমাদের দেশে ছোলার বাৎসরিক চাহিদা ৬৫ হাজার টন। সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে মজুদ আছে ২ লক্ষ ৬৫ হাজার টন। আমদানি ব্যয় ও সকল খরচসহ লভ্যাংশ ধরলে প্রতি কেজি ছোলার দাম দাড়ায় ৬৫-৬৮ টাকা। অথচ বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকা। অন্যদিকে রসুন এর আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য দাম বাড়ার অজুহাতে ও সরকারের শুল্ক আরোপ করা প্রতি কেজিতে যেখানে ১৮ টাকা প্রতি কেজিতে বৃদ্ধি পেয়েছে সেই সুযোগে আমদানিকারক ও মজুদদারদের কারসাজিতে প্রতি কেজি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা। পেয়াজের অবস্থাও একই। যেখানে এক সপ্তাহ পূর্বে এক পাল্লা পেয়াজের দাম ছিল ১২৫ টাকা। সেখানে বর্তমানে এক পাল্লা পেয়াজের দাম ২০০-২২০ টাকা। সরকার সয়াবিন তেলে লিটার প্রতি ৫ টাকা কমানোর নির্দেশ ও ভিটামিন প্রয়োগের নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন আজ অবধি হয়নি। রমজানে আরেকটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে হচ্ছে চিনি। বর্তমানে সরকারি মিলগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনির মজুদ রয়েছে। যা সরকার কোনভাবেই বিক্রি করতে পারছে না। ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চিনির উপর অতিরিক্ত সম্পূরক শুল্ক আরোপ করলে বর্তমানে এর দামও বৃদ্ধি পেয়ে ৬৫ টাকা হয়েছে অথচ আমদানি ব্যয় এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে দাম ধরলে ৪৫-৪৬ টাকার বেশি হবার কথা নয়। যা সরকারের ও অদূরদর্শিতার সিদ্ধান্ত বলে আমরা মনে করি। সম্প্রতি আমরা আরো দুঃখের সাথে লক্ষ করলাম যে, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে টিসিবি গরুর গোস্তের মূল্য ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করে। যা বাজারে বিক্রি হয় ৩৮০-৪০০ টাকায়। কিন্তু গেলো সপ্তাহে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহোদয় মাংস ব্যবসায়ীদের সাথে বসে নতুন দাম নির্ধারণ করেন। তাতে গরু গোস্তের দাম ৪২০ টাকা, খাসি ৫৭০ টাকা, ভেড়া ৪৮০ টাকা ও মহিষ ৩৮০ টাকা ধার্য করা হয়। এ ঘোষণার সাথে সাথে বাজারে ৪০০ টাকার স্থলে ৪৫০ টাকা দাম হয়ে যায়। সিটি কর্পোরেশন বা টিসিবির বাজারে দ্রব্যমূল্যের তালিকা দৈনিক টাঙানোর কথা থাকলেও কোন বাজারেই তা লক্ষ্য করা যায় না। অথচ জনমানুষের দুর্ভোগে ফেলার জন্য শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে দাম ঘোষণা করতে কার্পণ্য করেন না।
পানীয়র মধ্যে দুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাবার যা সেহেরীর সময় সকলেরই চাহিদা থাকে। অথচ সরকারের একটি নিজস্ব দুধ সরবরাহ করার কোম্পানী থাকলেও তারা দাম নিয়ন্ত্রণ না করে উল্টো সরবরাহ কম দেখিয়ে দাম বােিড়য়ে দেয়। ইফতারের সময় খেজুর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলের মধ্যে পড়ে। এছাড়াও দেশীয় ফলমূল এর চাহিদা তো আছেই। কিন্তু রমজানের সময় দেখা যায় নিম্ন মানের খেজুরে আর ফরমালিন ও ভেজাল ফলমূলে বাজার ছয়লাব। মাঝে মাঝে লোক দেখানোর নামে ভ্রাম্যমান আদালত থাকলেও তাতে কোন কাজে আসে না। অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে প্রস্তুত মালামালও বাজারে বিক্রি হয়। এসব প্রতিরোধের জন্য ক্রেতা-ভোক্তা সচেতনতার সাথে সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, র্যাব, পুলিশ, বিএসটিআই, সিটি কর্পোরেশন ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম জোরদার করার অনুরোধের পাশপাশি মোবাইল কোর্টসমূহ নিয়মিত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবেন, এই প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি।
সাম্প্রতিক সময় ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার বেশ কয়েকটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করেছে। তন্মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব আইন প্রণয়নের ফরে ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় আইনী কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এই আইনী কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৯ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হলেও এর কার্যক্রম এবং জনবল নিতান্তই অপ্রতুল। প্রতিযোগিতা আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। প্রতিযোগিতা কমিশন এখন পর্যন্ত গঠন করা হয়নি। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নামমাত্র শুরু হয়েছে। কর্যক্রম পরিচালনার জন্য এর কোন জনবল নেই। এ প্রেক্ষাপটে অবিলম্বে ভোক্তাবান্ধব আইন সমূহের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের অনুরোধ করছি। ভোক্তা সাধারণ মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল ভোগ করতে চায়। আর তা কেবল সম্ভব যখন বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবে। মানসম্মত পণ্য ও সেবার পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হবে। গুটিকতক ব্যবসায়ী কর্তৃক বাজার নিয়ন্ত্রণ কখনও ভোক্তাস্বার্থের অনুকূল হতে পারে না। সরকারকে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আরও প্রো-একটিভ হতে হবে। দেশের মানুষের আয়-উন্নতি হচ্ছে। বাড়ছে চাহিদা। এই বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের দেশজ উৎপাদন বাড়ানোর সাথে সাথে প্রয়োজনানুযায়ী প্রতিযোগিতামূলক আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে সরকারের অবস্থান দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে টিসিবি-কে সারা বছর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনার জন্য শক্তিশালী করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্য চিহ্নিত করে সারা বছর মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই ক্রেতা-ভোক্তা উপকৃত হবেন। জনকল্যাণমূলক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বাড়বে। টিসিবি খোলা ট্রাকে ১৭৯ টি ট্রাকের মাধ্যমে ৫টি ভোগ্যপণ্য বিক্রির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সারা বাংলাদেশ তো নয়ই বরং ঢাকা সিটিতে তা অপ্রতুল।
বিশ্ব বাজারে জ্বালানী তেলের মূল্য কমলেও বিপিসি উচ্চমূল্যে তেল বিক্রি করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। সম্প্রতি জ্বালানী মূল্যের দাম কমানোর কথা বলে জনগণের সাথে পরিহাস করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। ডিজেলের মূল্য ৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত ২০ মে গণপরিবহণে ৩ পয়সা প্রতি কিলোমিটার কমানোর কথা থাকলেও বাস্তবে বাসভাড়া না কমে উল্টো ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। রেল এবং নৌ-পরিবহণ ডিজেলে চালিত হলেও এর ভাড়া কমানোর কোন উদ্যোগই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমরা আশংকা করছি যে, ঈদকে কেন্দ্র করে গণপরিবহণের ভাড়া আরো একদফা বৃদ্ধি করা হতে পারে। তাই এখনই বিআরটিএ কে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনুরোধ রাখছি।
তাই আমরা মনে করি, রমজানকে কেন্দ্র করে জনগণের ভোগান্তি দূর করতে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছি।
* দিনের বেলা সকল হোটেল রেস্তোরা বন্ধ রাখতে হবে।
* নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যা রমজানে বেশি প্রয়োজন তার উপর হতে সকল প্রকার ভ্যাট, ট্যাক্স প্রত্যাহার করার সুপারিশ করছি।
* ঢাকা সিটির মতো সারাদেশেই খোলা ট্রাকে বা রেশনিং পদ্ধতিতে টিসিবিকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় করতে হবে।
* সরকারের গুদামে মজুদ চিনি ৩৬ টাকা দরে বিক্রি করার প্রস্তাব করছি।
* টিসিবির কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
* ভেজাল প্রতিরোধে সারা দেশে ভ্রাম্যমান আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
* ফরমালিন ও কার্বাইড মুক্ত ফল খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
* জনগণ যাতে যানজটে না পড়ে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
* ফুটপাত গুলো হাটার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
* সড়ক, রেল ও নৌ-পথের ভাড়া হ্রাস করতে হবে ও ঈদে ঘরমুখী জনমানুষের নিরবিচ্ছিন্ন যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে।
* ইন্টারনেট থেকে সকল অশ্লীল ছবি বন্ধ করতে হবে।