খোলা বাজার২৪, রোববার, ১২ জুন ২০১৬: সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেই সিজারের মাধ্যমে শিশু জন্ম বাড়ছে। সিজারের মাধ্যমে বছরে ৬ লাখের বেশি শিশুর জন্ম হয়। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল ব্যবসার স্বার্থে অস্ত্রোপচার করে প্রসূতিদের। সূত্র মতে, সরকারি হাসপাতালে ৩৪ শতাংশ, ৮০ শতাংশ লাভজনক প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ এনজিও প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমের শিশু জন্ম দিচ্ছেন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার হয়। মায়ের অপুষ্টি ও গর্ভকালীন সমস্যার কারণে প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়। মা ও নবজাতকের প্রাণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সিজারিয়ানে শিশু জন্ম বাড়ছে। খোদ চিকিৎসকরাই জানিয়েছেন, সিজারের কারণে মা এবং সন্তান দু’জনেই পতিত হচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগের ঘেরাটোপে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০১৪-এর তথ্য মতে, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের বাড়ার গতি ২০০৪ সালে ছিল ৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ছিল ৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ১৭ শতাংশ আর ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশ। এতে ৮ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষিত ও ধনিক শ্রেণির মধ্যে অস্ত্রোপচারের হার বেশি। দরিদ্র পরিবারে ৭ শতাংশ সিজারিয়ান করান। সরকারি হাসপাতালে ৩৪ শতাংশ, ৮০ শতাংশ লাভজনক প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ এনজিও প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমের শিশু জন্ম দিচ্ছেন।
২০১৪ সালে এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী প্রচণ্ড প্রসব ব্যথা নিয়ে ঢাকার উত্তরায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। তার সব রিপোর্ট দেখে ডাক্তাররা বলেন, নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চা প্রসব করা যাবে না সিজার করতে হবে। এরপর সিজারের মাধ্যমে একটি ছেলে বাচ্চা প্রসব করেন তিনি। জন্মের পর ওই নবজাতককে শিশুদের পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয় শ্বাস কষ্ট আছে বলে। সেখান থেকে ৪ দিন পর ওই নবজাতককে মায়ের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। সেখানে সব মিলিয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা দম্পতির বিল আছে দেড় লাখ টাকা। তাদের নবজাতকটি কতোটা প্রাণসঙ্কটে ছিল সেটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। শুধু তাই নয় একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, উত্তরার সেই হাসপাতালে ছেলে শিশুর জন্ম হলে ইনকিউবেটরে দেওয়া হচ্ছিল। আর মেয়ে শিশু হলে মায়ের কাছে দেওয়া হচ্ছিল যা সন্দেহের জন্ম দেয়!
২০১৫ সালে ৫ই জুন, বেসরকারি আরেকটি ক্লিনিকে কন্যা সন্তান জন্ম দেন এক নারী। ওই ক্লিনিকের চিকিৎসক ওই নারীকে বারবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের কথা বলেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। কিন্তু স্কুল শিক্ষিকা ওই নারী মনের দিক থেকে অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। ফলে সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু প্রসবে তিনি নেতিবাচক মনোভাব দেখান। স্বাভাবিকভাবে প্রসবে মত দেন তিনি ও তার স্বজনরা। প্রসবের পর থেকে মা-বাচ্চা স্বাভাবিক ছিলেন।
ভুক্তভোগীরা বলেন, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে বাচ্চা প্রসব করলে হাসপাতালের আয় হয় অতিরিক্ত টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়ী মনোভাব আর ডাক্তারদের উদাসীন মনোভাবই এর জন্য দায়ী। বিভিন্ন হাসপাতালে একটি সিজারিয়ান অপারেশন করতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। অভিযোগ রয়েছে, দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের সিজারিয়ান সেকশন এখন বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কোনো প্রসূতি পেলেই ওই সব হাসপাতালের এক শ্রেণির চিকিৎসক ও কর্মচারী বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয়.
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডেলিভারি করার সময় মাকে যেসব অ্যানেস্থেটিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তা নবজাতকের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারেও বাধা হয়ে উঠতে পারে। সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম নেয়া নবজাতক শিশুর হাসপাতালে থাকার সময়কাল বেশি বলে তাদের ইনফেকশন ঝুঁকি থাকে। এছাড়া বড় হওয়ার সাথে বিভিন্ন ধরনের রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের ডা. মুন বলেন, সিজার এখন স্বাভাবিক ঘটনায় দাঁড়িয়ে গেছে। দিন যত এগুচ্ছে এর প্রবণতাও বাড়ছে। যা মোটেই সুখকর সংবাদ নয়। এরজন্য শুধু এক শ্রেণীর অসাধু ডাক্তার-হাসপাতালকে দায়ী করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ইদানীং শহরকেন্দ্রিক সিংহভাগ মা ও তার পরিবার সিজার নামক শর্টকার্ট পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিতে চান। তারা স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ২/৩ দিন অপেক্ষা এবং প্রসবের ব্যথা সহ্য করতে চান না। এটাই হলো বর্তমান সমাজের নির্মম বাস্তবতা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধে দেশের নারীদের সচেতন হতে হবে। সন্তান জন্মের সময় প্রসব যন্ত্রণা সয্য করার মতো মানসিকতা রাখারও পরামর্শ দেন তারা।