Thu. Apr 24th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1kখোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০১৬: ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে ঝিনাইদহের পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী হত্যা করা হয়। এতে নেন জামায়াতের অঙ্গসংগঠনটির আট নেতাকর্মী। এদের হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া এনামুল হককে ঢাকার গাবতলী থেকে আটক করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ঝিনাইদহের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা জাহাঙ্গীরের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বাকীরোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এনামুল হক (২৪)। তাঁর দেওয়া ছয় পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে হত্যায় অংশ নেওয়া শিবির নেতাকর্মীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশ করতে চায়নি পুলিশ।
এই তথ্যে ভিত্তিতে সাতজনকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এদের বাড়ি ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরায়। পুলিশের ধারণা, তাদের গ্রেপ্তার করা গেলে টার্গেট কিলিংয়ে (উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যা) হুকুমদাতাদের নাম বেরিয়ে পড়বে।
গতকাল এনামুলকে আদালতে হাজির করা হলে তাঁকে তিন ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। বিকেল ৪টার দিকে তিনি জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন। ৬টা ৩৫ মিনিটে তাঁর দেওয়া জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা শেষ হয়। ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাসান হাফিজুর রহমান।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ছাত্রশিবির নেতা এনামুল হক বলেছেন, ‘আমি ঝিনাইদহ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সেক্রেটারি। গত ৩ জুন মাগরিব নামাজের পরে পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ঈদগাহ মাঠে যাই। দেখি সেখানে আগে থেকেই দুজন দাঁড়িয়ে আছে। ওই দুজন যারা স্থানীয় আমাকে জানান, কেন্দ্রীয় নির্দেশে করোতিপাড়ার পুরোহিত আনন্দ গোপালকে হত্যা করতে হবে। আমি বলি, ৪ জুন আমার অনার্স পরীক্ষা, ৬ জুন শেষ হবে। এ ক্ষেত্রে ৭ জুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়। ৬ তারিখে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে অনার্স শেষ পর্বের লিখিত পরীক্ষা শেষ করে রাতেই ঝিনাইদহে ফিরে আসি। ওই রাতে (প্রথম রমজানের সেহরি খাওয়ার পরে) সকাল ৭টার দিকে শিকারপুর পৌঁছাতে হবে মর্মে আমার মোবাইল ফোনে মেসেজ দেওয়া হয়।’
জবানবন্দিতে এনামুল বলেছেন, ‘নিদের্শ মোতাবেক শিকারপুর সেতুর কাছে যাওয়ার পর কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করি। ৃভাই ( নাম প্রকাশ করা হলো না ) মোটর সাইকেল চড়ে সেখানে আসে । ভাইয়ের সঙ্গে আরেকজন ছিল (নাম প্রকাশ করা হলো না )। তার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তারা আমাকে মোটরসাইকেলে উঠিয়ে নেন। সদর উপজেলার নাচনা রোডে উঠে সেখান থেকে বাগডাঙ্গা গ্রামের ভেতর দিয়ে আড়পাড়া রোডে উঠি। সেখানে হাফেজ ( নাম প্রকাশ করা হলো না ) দাঁড়িয়ে ছিল। হাফেজ আমাদের সঙ্গে একজনের হাতে শপিংব্যাগ দেয়। সেই ব্যাগে ২টা চাপাতি লুঙ্গিতে মোড়ানো ছিল। এরপর হাফেজ ভাই পুরোহিত আনন্দ গোপালের বাড়ির রাস্তায় এসে অবস্থান নেন। আরেকজন সোনাইখালী রাস্তার দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয়। মহিষাভাগাড় এলাকায় পৌঁছামাত্র সকাল সোয়া ৯টার দিকে হাফেজ ভাই মোবাইল ফোনে আমাকে মেসেজ দেন যে, পুরোহিত যাচ্ছে। কিছু সময় পর আমরা পুরোহিতকে দেখতে পাই। পুরোহিত আমাদের সামনে দিয়ে বাইসাইকেল চড়ে ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকেন। লাল রঙের মোটরসাইকেলে করে পিছু নিই আমরা। ব্যাগ থেকে চাপাতি ২টা বের করে মহিষাভাগাড় এলাকায় বাইসাইকেলের গতিরোধ করি। তখন পুরোহিত বাইসাইকেল থেকে নেমে পড়েন।’
এনামুল হক জবানবন্দিতে আরো বলেছেন, ‘আমি প্রথমে পরোহিতের ঘাড়ের পেছন দিকে চাপাতি দিয়ে ২/৩টি কোপ মারি, হাতেও একটি কোপ দিই। পুরোহিত মাটিতে পড়ে গেলে ভাই (নাম প্রকাশ করা হলো না) তাকে জাবাই করেন। পুরোহিত মারা গেলে মোটরসাইকেলে উঠে পড়ি। অন্য ভাইয়ের মোটর সাইকেলে আগে থেকে চড়ে ছিলেন। এরপর শপিংব্যাগে চাপাতি ভরে একটি কলাবাগানে ফেলে দেই।’
এনামুলের ভাষায়, ভিকসর, আড়মুখ এলাকা হয়ে কালীচরণপুর যান তাঁরা। সেখানে মোটরসাইকেল থেকে নেমে হত্যার বার্তা পাঠানো হয়। এরপর বয়ড়াতলা বাজারে এনামুল নেমে পড়েন। অপর দুজন চলে যায়। ঘটনার দিন রাতেই তিনি ঢাকায় চলে যান।
জবানবন্দির একটি অংশে এনামুল বলেন, ইসলামের শক্রদের খতম করতে হবে কেন, এমন প্রশ্ন করেছিলেন তিনি ভাইদের ( শিবির নেতা) কাছে। তখন তাকে বলা হয়েছিল, ‘জেলা কমিটির নির্দেশে গান্না বাজারে সমির খাজা ও কালীগঞ্জে হাফেজ ডাক্তার আব্দুর রাজ্জাককে হত্যা করা হয়েছে। তখন তো এমন প্রশ্ন কেউ করেনি।’
ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মো. আলতাফ হোসেন আজ বুধবার দুপুরে বলেছেন, এনামুল ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য। তিনি সরকারকে বিব্রত করতে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নিরীহ পুরোহিত হত্যায় অংশ নিয়েছেন।
পুলিশ সুপার আরো জানান, এই জেলার কালীগঞ্জের আব্দুর রাজ্জাক ও সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের ভিন্নধার্মলম্বী সমির খাজার হত্যার সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রশিবির নেতারা জড়িত। পুরোহিত হত্যায় মোট সাতজন অংশ নিয়েছে বলেও জানান এসপি। এদের নাম এনামুল তাঁর স্বাকারোক্তিতে উল্লেখ করেছে বলে জানান তিনি।
পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন জানান, স্থানীয়ভাবে ছাত্রশিবিরের পৃথক দল এ সব ঘটনা ঘটিয়েছে।
গত সোমবার রাত ২ টা ২০ মিনিটে ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে এনামুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের এই কর্মকর্তার ভাষায়, পুরোহিত হত্যা মামলার তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এনামুলের দেওয়া তথ্যর সুত্র ধরে শিবিরের সাতজন নেতাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আড়মুখ কুঠিপাড়ার ফজলুল হক জোয়ারদারের ছেলে এনামুল হক। তিনি ২০০৪ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেন। গ্রামের মাদ্রাসা থেকে এসএসসি (সমমান) পাস করে ঝিনাইদহ জেলা শহরের আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এইচএসসি সমমানে পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর তিনি ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র মোহন কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন।
পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, এনামুল ফেসবুকে সক্রিয় এবং নানা ধরনের লেখালেখি করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করেও তিনি তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলে জানান ঝিনাইদহের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোপীনাথ কানজি লাল।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, আনন্দ গোপাল হত্যার সময় ধরে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে এনামুলের সন্ধান পান তাঁরা।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছেন, হ্ত্যাকারীরা, ভাইবার, ট্যাংগো সফটওয়ার ব্যবহার করেছে। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয়ভাবে শক্তিশালী আইটি বিভাগ রয়েছে। তবে দেশের কোন স্থান থেকে সেটি পরিচালনা করা হয় তা জানতে পারেনি পুলিশ।