খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৪ জুলাই ২০১৬: ঢাকা হামলার পর বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ নতুন মোড় নিয়েছে। এতদিন ব্যাক্তিবিশেষ তথা ‘সফট টার্গেটে’র ওপরই হামলা চালানো হয়েছে। ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট থেকে শুরু করে বিদেশী, প্রকাশক, লেখক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সংখ্যালঘু Ñ সবার ঘাড়েই পড়েছে জঙ্গিদের আঘাত। কিন্তু গুলশানের ¯প্যানিশ রেস্তোরাঁয় জিম্মি সংকট ও ২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার ঘটনা একেবারেই আলাদা।
নেতিবাচক কারণে বারবার বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। ধারাবাহিক হত্যাকা- নিয়েও হয়েছে। কিন্তু ঢাকা হামলা যেন ছাড়িয়ে গেছে সব মাত্রা। ঘন্টার পর ঘন্টা নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, বিবিসি সহ বিশ্বখ্যাত সব গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে প্রধান শিরোনাম ছিল ঢাকা হামলা। ছাপা হয়েছে পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য, প্রচুর উপ-স¤পাদকীয় ও কলাম। বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকের মন্তব্য, এ ধরণের হামলা অনুমিতই ছিল। রাজনৈতিক বিরোধীদের স্থান সঙ্কুচিত করেছে সরকার। ফলে সৃষ্টি হয়েছে শূন্যস্থান, যা পূরণে লড়াইয়ে নেমেছে জঙ্গি সংগঠনগুলো।
ওয়াশিংটন পোস্টে কলামিস্ট ইশান থারুরের নিবন্ধের নামই ছিল: ঢাকার সন্ত্রাসী হামলায় অবাক হওয়া উচিৎ নয় কারও। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘হাসিনা সরকার দেশে জঙ্গিবাদী সহিংসতার বিস্তার মোকাবিলার চেয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করা ও প্রতিপক্ষকে দমানোর কাজে অধিক শক্তি ব্যয় করেছে।’ তার বিশ্লেষণ, ‘সন্ত্রাসবাদের নিরব ছায়ায়, শেখ হাসিনার শাসক সরকার তাদের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্বপরায়ণ স্টাইলের জন্য সমালোচিত হচ্ছে। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে এ ধরণের হামলার ঝুঁকিতে ফেলেছে।’
ভারতের পত্রিকা দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের স¤পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করাটা অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ, এগুলো হলো দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান গভীর ত্রুটিপূর্ণ কার্যপ্রণালীর ফসল। আর এই ত্রুটিপূর্ণ কার্যপ্রণালির একাধারে ফসল ও চালক হলো শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ দল ও তার সরকার।’ স¤পাদকীয়তে আরও বলা হয়েছে, ‘বিএনপির মতো বিরোধী দলগুলোর ওপর ব্যাপকমাত্রায় নির্যাতনের নেতৃত্বে রয়েছে হাসিনার সরকার। এটি ছাড়াও, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দলীয় প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতাকে আরও পুষ্ট করেছে এবং চরমপন্থী সংগঠন ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর আবেদন বৃদ্ধি করেছে।’ বলা হয়েছে, ‘সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরণের সংকট প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশ, যার অন্যতম প্রকাশ হলো সন্ত্রাসবাদ। ষড়যন্ত্রকারীদের খোঁজার দিকে তৎক্ষণাৎ মনোযোগ থাকবে এখন। কিন্তু বাংলাদেশের এখন নিদারুনভাবে নতুন ধরণের রাজনীতি ও একগুচ্ছ পদক্ষেপ প্রয়োজন যা সামাজিক অস্থিরতাকে বাগে আনবে। কিন্তু এখন একে দুরাশা বলেই মনে হচ্ছে।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসের সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বিদেশ প্রতিবেদক রুকমিনি ক্যালিম্যাচির পর্যবেক্ষণ, নিজেদের কর্মীদেরকে আইএস ইউরোপে ‘যে কাউকে’ হত্যা করার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের হামলাগুলোর দিকে আরও গভীর দৃষ্টিতে দেখলে ধরা পড়বে, আইএস ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে হামলার সময় মুসলিম কাউকে হত্যার ব্যাপারে সতর্ক থাকছে তারা। গুলশানের ঘটনায় মুসলমানদের চিহ্নিত করে আলাদা করা ও শুধুমাত্র বিদেশী বা অমুসলিমদের হত্যা করার বিষয়টি আইএস’র প্রচারণায় জোর পেয়েছে বেশি।
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক আনবারাসান এথিরাজান এক বিশ্লেষণে উপসংহার টেনেছেন, ‘বাংলাদেশের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও নিরাপত্তা কাঠামোতে যে বড় ধরণের ফাঁক রয়েছে, তা এ ঘটনায় উন্মোচিত হয়েছে। অনেকে এমনকি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এর ফলে, উদ্বেগ রয়েছে যে, সরকার যদি নিজেদের ঘাটতির বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে এর দরুন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা পশ্চাৎমুখী হয়ে উঠতে পারে।’
দ্য গার্ডিয়ানে বিশ্লেষক ও সাংবাদিক জ্যাসন বার্ক ‘অনিয়ন্ত্রিত সহিংসতার অনুমিত ফল বাংলাদেশ হামলা’ শীর্ষক এক কলাম লিখেছেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের সহিংসতা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোড়ন তৈরি করলেও, দুনিয়ার নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অতটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেনি। বিশেষ করে দেশটিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বহুত্ববাদ ও সহনশীল ঐতিহ্যের স্থান সঙ্কুচিত হওয়ার দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অতটা মনোযোগ নেই। তবে তার ভাষ্য, ‘এ হামলার পর এসবের পরিবর্তন ঘটবে। ঢাকার কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক Ñ উভয়ের পক্ষে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের হুমকি উপেক্ষা করাটা এখন আরও কঠিন।’
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে সৈয়দ জৈন আল মাহমুদ লিখেছেন, হামলার সময় আইএস’র নিজস্ব বার্তাসংস্থা আমাক নিহতদের বিভিন্ন নৃশংস ছবি প্রকাশ করে। তার ভাষ্য, ‘দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিদের সঙ্গে সিরিয়া ও ইরাকে অবস্থানরত ইসলামিক স্টেট যোদ্ধাদের যোগাযোগ হচ্ছে Ñ এ ছবিগুলো হলো তার সর্বশেষ প্রমাণ। মুসলিম বিশ্বের এমন এক অংশে, যেখানে মৌলবাদ তুলনামূলকভবাবে কম, সেখানেও কিছু সমর্থক যে আইএস জুটিয়ে ফেলেছে, তারও নতুন লক্ষণ এটি।’ তার লেখায় উঠে আসে, ‘প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপি চেষ্টার অভিযোগ তুলে ২০১৪ সালের নির্বাচন বিরোধী দল বয়কট করে। তবে তিনি তা অস্বীকার করেছেন। কিছু বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে তা চরমপন্থার উর্ধ্বগতিতে সহায়ক হবে। এছাড়া সরকার এখন পর্যন্ত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় সংলাপ আয়োজন করতে বিরোধীদের আহবান প্রত্যাখ্যান করে আসছে।’
অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন টাইমসে কলামিস্ট ও সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার প্রধান বিদেশ প্রতিবেদক পল ম্যাকগফ ঢাকা, ইস্তাম্বুল ও ফালুজার মধ্যে সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ইরাকের ফালুজায় সরকারী বাহিনীর কাছে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি হারানোর পর ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে আইএস’র অবস্থান। এ কারণে এ গোষ্ঠী দুনিয়ার সামনে নিজেদের প্রভাবের জানান দেয়ার শক্তিশালী উপায় খুঁজছিল। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে হামলা ও ঢাকার রেস্তোরাঁ হামলা তারই ফল। গার্ডিয়ানে জ্যাসন বার্ক ভিন্ন আরেকটি কলামেও একই যুক্তি দেখিয়েছেন। সিনেটের ইন্টিলিজেন্স কমিটির শুনানিতে গত মাসে সিআইএ’র প্রধান জন ব্রেনান একই পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন। পল ম্যাকগফ লিখেছেন, নিজেদের স্বঘোষিত খিলাফতে ভ’খ- হয়তো হারাচ্ছে আইএস। কিন্তু প্যারিস ও ব্রাসেলস হামলার মতো দূরবর্তি হামলাগুলোর মাধ্যমে ‘ভার্চুয়াল খিলাফতের’ জানান দিতে চায় আইএস। আর ঢাকা ছিল এ প্রচেষ্টার পরীক্ষাক্ষেত্র।
বার্তাসংস্থা এএফপি’র একটি প্রতিবেদনে এ হামলার দরুন বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ও গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বিদেশী ক্রেতারা এ হামলার দরুন নিরুৎসাহিত বোধ করতে পারে।
বিবিসি’কে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলেন, এ হামলা মোকাবিলায় রাজনৈতিক কৌশল থাকতে হবে ও সর্বস্তরের মানুষকে যুক্ত করতে হবে। তিনি সরকারকে রাজনৈতিক ঐক্যমত গড়ার পরামর্শও দিয়েছেন। তার মতে সরকারের বর্তমান কৌশল কাজে দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘এখন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার যাতে সমাজের, সিভিল সোসাইটির, বিরোধী দলের সবাইকে একত্রিত করে একটা জাতীয় ঐক্য তৈরি করা যায়। রাজনৈতিক মতপার্থক্যগুলোকে যতদূর সম্ভব দূরে রেখে এবং যতদূর সম্ভব ঐক্যমত্য তৈরি করেই অগ্রসর হতে হবে।’