খোলা বাজার২৪, শনিবার, ২৩ জুলাই ২০১৬: সিরাজী এম আর মোস্তাক : প্রতিটি ক্রসফায়ার সিনেমার একেকটি দৃশ্যের ন্যায়। এমন কিছু দৃশ্য নিয়ে হয় নাটিকা। ০১ জুলাই, ২০১৬ তারিখে গুলশান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনা তুলনামুলক বড় দৃশ্য। এটি ক্রসফায়ারের নাটিকা। ক্রসফায়ারে সাধারণত এক বা দুজনকে হত্যা করা হয়। গুলশান হামলায় একসাথে ছয়-সাত জঙ্গিকে ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। আগামীতে ক্রসফায়ারের পুর্ণাঙ্গ নাটক বা সিনেমা আসবে। তখন অনেক বেশী ক্রসফায়ার হবে। ইতিমধ্যে তার কাজ শুরু হয়েছে। গুলশানের ক্রসফায়ারের ঘটনাকে জঙ্গিকর্ম প্রচার করে অসংখ্য নিরীহ নাগরিককে আটক করা হচ্ছে। সারাদেশে কথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। তাই দেশ-বিদেশের নিরীহ নাগরিকদেরকে আসন্ন ক্রসফায়ারের সিনেমা সম্পর্কে সচেতন করাই আলোচ্য শিরোনামের উদ্দেশ্য।
ক্রসফায়ার হলো, পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের মাঝে সংঘটিত সাজানো বন্দুকযুদ্ধ। এতে কথিত সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশের যিম্মাায় থাকা ব্যক্তি ক্রসফায়ার হয়। আজ পর্যন্ত পুলিশ কথিত সংঘর্ষকারী সন্ত্রাসীদের কাউকে আটক করেনি। অর্থাৎ সন্ত্রাসীদের কাছে পুলিশ ব্যর্থ। যেমন, গত জুন মাসে আদালত কর্তৃক রিমান্ড আদেশের পরও পুলিশের হাতকড়া অবস্থায় কথিত জঙ্গি ফাহিম সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়। এতে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সে প্রতিবাদ ঠেকাতে ঝিনাইদহে মেধাবী যুবক শহীদ আল মাহমুদ ও প্রকৌশলী আনিছুর রহমানকে ক্রসফায়ার দেয়া হয়। তার তিন ঘন্টার মাথায় মন্দিরের সেবায়েত গোসাইরকে কুপিয়ে জখম করা হয়। পরদিন ইবনুল ইসলাম পারভেজ নামে আরেক মেধাবী যুবককে ক্রসফায়ার দেয়া হয়। এরপর আরেক সেবায়েত সেবানন্দ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ক্রসফায়ারের এসকল ঘটনা পরস্পর সংশ্লিষ্ট। গুলশান রেষ্টুরেন্টে হামলা তারই ধারাবাহিকতা। এটি জঙ্গি হামলা নয়, ক্রসফায়ারের ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।
ক্রসফায়ারে কতিপয় পুলিশও আহত হয়। তাদেরকে চিকিৎসা দেয়া হয়। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরা হামলায় হুবহু তাই হয়েছে। দুজন পুলিশ নিহত এবং বেশ কজন আহত হয়েছে। কয়েকজন দেশী-বিদেশী মান্য-গণ্য ব্যক্তি নিহত হয়েছে। ছয়-সাতজন জঙ্গি ক্রসফায়ার হয়েছে। যারা ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে, তারা অনেক আগেই নিখোঁজ বা পুলিশের হাতে আটক ছিল। তাদের সবাইকে একসাথে ক্রসফায়ার দিতেই গুলশান হামলার নাটিকা পরিবেশিত হয়েছে।
ক্রসফায়ারের ঘটনা রাতের অন্ধকারে বা মিডিয়ার আড়ালে হয়। গুলশান হামলাও মিডিয়ার বাইরে ছিল। প্রশাসন আমাদের দক্ষ মিডিয়া কর্মীদেরকে হামলার চিত্র তুলতে এবং প্রচার করতে বাধা দেয়। তাই পরদিন সামরিক অভিযানের পর প্রশাসনের কালো গাড়ীতে কে কিভাবে পার হয়, তা ক্রসফায়ারের ঘটনার মতোই আড়াল থাকে। প্রশাসন যা বলে, তাই বিশ্বাস করতে হয়। অতএব, গুলশানের ঘটনা ক্রসফায়ার ছাড়া আর কি?
গুলশানে ঘটনার শুরুতেই পুলিশ হতাহত হয়। অথচ প্রচার করা হয়, হামলাকারী জঙ্গি মাত্র ছয়-সাতজন। আমাদের হাজার হাজার দক্ষ পুলিশ বাহিনী নিজেদের সহকর্মী হতাহতের পরও মাত্র কয়েকজন জঙ্গির বিরূদ্ধে সারারাতেও অভিযান চালাতে ব্যর্থ হয়। এ বিষয়টি কতই না লজ্জার! আবার এত কম সংখ্যক জঙ্গি কিভাবে ২২ জন লোককে কুপিয়ে হত্যা করলো, তাও ভাবার বিষয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে, মাত্র একজনেরই হাতে ছিল ছুড়ি বা তলোয়ার। জঙ্গিরা পনেরজন জিম্মিকেও ছেড়ে দিয়েছে, তা আরো আশ্চর্য্য ব্যাপার। অর্থাৎ গুলশান হামলার ঘটনা ক্রসফায়ারের মতোই রহস্যাবৃত।
অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীরাই গুলশানে হামলা করেছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি? শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগী দুই লাখ ব্যক্তিই কি দেশ স্বাধীন করেছে? বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, জেনারেল এম এ জি ওসমানী, ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন, লাখ লাখ শরণার্থী, বন্দি, আত্মত্যাগী এবং বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘৭১ এর সাড়ে সাতকোটি সংগ্রামী বাঙ্গালি কারো নামই নেই। তারা কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? তারা কি রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন? তাদের তালিকা নেই কেন? শুধু দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত কেন? এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? মূলত যাদেরকে ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে, তারা সবাই উক্ত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার চেতনা বিরোধী বা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী। কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় তাদেরকে ধরা হয়েছে। তাদের এ চেতনা যেন সারাদেশে না ছড়ায় বা দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী আন্দোলন না হয়, সেজন্যই তাদেরকে জেল থেকে এনে জঙ্গি দেখানো হয়েছে। আসলে এটি জঙ্গি হামলা নয়, রাজনৈতিক ষঢ়যন্ত্র।
বলা হচ্ছে, জঙ্গিরা ধর্মীয় উম্মাদনার বশে গুলশানের ঘটনা ঘটিয়েছে। তা কি ঠিক? তাহলে ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো কিসের তাড়নায় হচ্ছে? প্রশাসন কেন সমাজের সবচেয়ে নিরীহ ও সৎ মানুষদেরকে ক্রসফায়ারে দিচ্ছে? আইন ও বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুলিশের হাতকড়া অবস্থায় কেন ফাহিমকে হত্যা করা হয়েছে? ঝিনাইদহে মেধাবী ছাত্র ও প্রকৌশলীকে কেন ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে? আদালতের গেটে শত শত মানুষের কাছ থেকে সাঈদীর সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে কারা গুম করেছে? এগুলো কি আইনসম্মত?
গত ০৫ জুন, ২০১৬ এসপি বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে হত্যার পর সাঁড়াশি অভিযানের নামে হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ উক্ত হত্যাকান্ডের কথিত মূল সন্দেহভাজন দুজনকেই ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। ফলাফল কী দাঁড়ালো? বিরোধী জোটের হাজার হাজার গ্রেপ্তারের শিকার হলো। গুলশান হামলার পরও সন্ত্রাস দমনের নামে ভিন্ন নাটক পরিবেশিত হচ্ছে। বহু মানুষ জুলুমের শিকার হচ্ছে। এভাবে যখন ক্রসফায়ারের সিনেমা মুক্তি পাবে, তখন দেশ ও দেশবাসীর কি হবে, তা কেউ জানে না।
অতএব, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হামলা, হত্যাকান্ড ও তার নেপথ্য নায়ক সবই স্পষ্ট। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডই এর মূলসূত্র। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মিথ্যাচারিতা ও ব্যর্থতাও উল্লেখ্য। বিচারবিভাগের নিস্ক্রিয়তাও অন্যতম। আমাদের উচিত, অযথা জঙ্গি হামলার নামে নিজেদের ভাবমুর্তি নষ্ট না করা। ক্রসফায়ারের সাজানো গল্প, নাটক ও সিনেমা বাতিল করে ষোল কোটি নাগরিকই মুক্তিযোদ্ধা; এই চেতনায় বাংলাদেশ গড়া।