খোলা বাজার২৪, রোববার, ৩১ জুলাই ২০১৬: প্রসারে কাজ করছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিকদের একটি চক্র। এদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে আবার কেউ কেউ সপরিবারেও উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তারা দেশের আত্মীয়স্বজনসহ পরিচিত তরুণ-তরুণীদের নানা কৌশলে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বর্তমানে ভিনদেশী নাগরিক হওয়ায় এ চক্রের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। তাদের পূর্বপূরুষ বহু আগেই দেশ ছেড়েছেন। এদের সংখ্যা কত সে হিসাবও নেই সরকারের কাছে। বিভিন্ন সময় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। কিছু তথ্য এসেছে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে। ওই তথ্য নিয়েই কাজ করছে পুলিশ। চেষ্টা করছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহের।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘যারা দু’তিন পুরুষ আগে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন এ ধরনের বাংলাদেশী মা-বাবার ঘরে যাদের জন্ম তাদের অনেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। তারা আবার দেশে থাকা বিভিন্ন জনকে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে দীক্ষা দেয়ার চেষ্টা করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে এসব প্রবাসীর অপকর্মের দায়ভার চাপানো হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর। অথচ তারা অন্য দেশের নাগরিক। তাদের নিয়ন্ত্রণই আমাদের কাছে নেই। আমরা বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের বিষয়ে কাজ করছি।’
জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করে পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (গোপনীয়) মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিক বা প্রবাসী বাংলাদেশীদের কেউ উগ্রপন্থীদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে আমরা খোঁজ নিচ্ছি। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ভিনদেশী নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারা নানাভাবে দেশের তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পুলিশ সদও দফতর থেকে বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে।’
সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা ও কল্যাণপুরের অভিযানের পর নাম এসেছে তামিম চৌধুরীর। তার বাবা সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার দুরাগ গ্রামের বাসিন্দা শফিকুর রহমান চৌধুরী। বিদেশী জাহাজে কাজের সুবাদে এই শফিকুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই সপরিবারে কানাডায় চলে যান। ২০০১ সালে সপরিবারে দেশে আসেন। সর্বশেষ কানাডার অন্টারিওর উইন্ডসরে থাকতেন তামিম। বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী তামিম বাংলাদেশে কথিত আইএস খেলাফতের সমন্বয়ক। বাংলাদেশে তরুণদের উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়ানো ও তাদের অর্থ দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কথিত আইএসের কাছে তার ছদ্মনাম শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। এই তামিম চৌধুরীই দেশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এমন তথ্য পেয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজি ভারত সফরকালে তামিমের বায়োডাটা দিয়ে তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছেন। কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় তামিমের যাতায়াতের বিষয়টি পুলিশকে নিশ্চিত করেছে আস্তানা থেকে গ্রেফতার হওয়া আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে রিগেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত অর্ধশত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিভিন্ন দেশের নাগরিকের সরাসরি ইরাক বা সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছে। এমন তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ওই দলে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কিছু তরুণীর নামও আছে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে খেলাফত কায়েমের ঘোষণা দেয় আইএস। প্রতিষ্ঠার পর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ-তরুণীদের নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ঢাকার মিলিটারি ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমান ওরফে জিলানী আইএসে যোগ দেন। তার বাবা ছিলেন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত একজন সেনা কর্মকর্তা। এই তরুণ ২০০৩ সালে শিক্ষা ভিসায় ঢাকা থেকে লন্ডনে যান। ২০১৫ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি আশেকুর একটি সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য তুরস্ক হয়ে লিবিয়ায় গিয়ে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হন। ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ার রাকা প্রদেশের কাছে বিমান হামলায় নিহত হন আশেকুর। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আশেকুর আইএসের হ্যাকিং দলের প্রধান ছিলেন। তার ছদ্মনাম ছিলে আবু জান্দাল আল-বাঙালি। আইএসের ম্যাগাজিন দাবিকে তার সম্পর্কে বলা হয়, ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আবু জান্দাল ‘জিহাদ’-এর প্রতি নানাভাবে আকৃষ্ট হওয়া তরুণ আইএসের জন্য অর্থসংস্থানও করেছেন। তিনি তার বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
আশেকুরের মৃত্যুর পর আরও এক তরুণের মৃত্যুর খবর দেয় আইএস। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ওই নাগরিকের নাম বলা হয় আবু দোজানা আল-বাঙালি। ব্রিটিশ পুলিশের দাবি; ওই তরুণের প্রকৃত নাম মেহেদী হাসান। সিরিয়া যাওয়ার পর নামকরণ হয়েছে আবু দোজানা আল-বাঙালি। ‘ব্রিটেনি ব্রিগেড বাংলাদেশী ব্যাড বয়েজ’ নামে গ্রুপ তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্যে যায় মেহেদী। বাবা-মার সঙ্গে মেহেদী থাকতেন ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে পোর্টসমাউথের ছয় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ সিরিয়ায় চলে যায়। ওই গ্রুপের প্রধান ছিলেন ইফতেখার জামান। তার নেতৃত্বে মেহেদী হাসান, মামুনুর রশিদ, হামিদুর রহমান, মাসুদুর চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান। এর মধ্যে ইফতেখার নিহত হন সিরিয়া যাওয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে নিহত হন হামিদুর রহমান, ২১ অক্টোবর মামুনুর রশিদ ও ২৪ অক্টোবর নিহত হন মেহেদী হাসান ওরফে আবু দোজানা। একই সময়ে নিহত হন লন্ডন সিটির আবু হামজা জাকির নামের আরেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ। বন্ধুদের নির্মম মৃত্যুর পর ওই দলের মাসুদুর চৌধুরী (৩১) সিরিয়া থেকে পালিয়ে ব্রিটেনে ফেরার পথে গ্রেফতার হন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উগ্রবাদে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে মেহেদী হাসান ওরফে আবু দোজানা আল-বাঙালির কার্যক্রম ছিল চোখে পড়ার মতো। এই ব্রিটিশ তরুণ নিজেকে বাংলাদেশী যোদ্ধা হিসেবে দেখিয়ে অন্য তরুণদেরও আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। পরে তার বন্ধুরাও এই ধারা অব্যাহত রাখে।
যাচ্ছে তরুণীরাও : শুধু তরুণই নয়, লন্ডনের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কয়েক তরুণীও এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। গত বছর পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন একাডেমি নামে একটি স্কুলের তিন ছাত্রী সিরিয়ায় চলে যায়। তাদের মধ্যে দু’জন শামিমা বেগম (১৫) ও খাদিজা সুলতানা (১৬)। তারা লন্ডনি উচ্চারণে ইংরেজি ও সিলেটি উচ্চারণে বাংলা বলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও বেশ কিছু তরুণী উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ও বাংলাদেশে থাকা অপর তরুণ-তরুণীদের উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে উৎসাহ জোগাচ্ছেন।
সিরিয়ায় পুরো পরিবার : সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মাইজগাঁও গ্রামের আবদুল মান্নানের পরিবারের ১২ সদস্য গত বছরের ১১ মে সিরিয়ায় চলে যান। ৮০ বছর বয়স্ক মান্নান ব্রিটিশ নাগরিক। ৪০ বছর ধরে সপরিবারে সেখানে অবস্থান করছিলেন। মান্নানের স্ত্রী মিনারা খানম, ছেলে তৌফিক হোসাইন, মেয়ে রাজিয়া খানম, পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনি নিয়ে এক মাস ছুটি কাটাতে ফেঞ্চুগঞ্জ আসেন। লন্ডন ফেরার পথে গত বছরের ১১ মে নিখোঁজ হন। পরে আত্মীয়দের ফোন করে সিরিয়ায় যাওয়ার কথা জানান। এই দলে তিন শিশুও রয়েছে। মান্নানের মেয়ে রাজিয়া খাতুন তার একাধিক বান্ধবীকে ফোন করে সিরিয়ায় যাওয়ার জন্য উদ্বুব্ধ করেছিল। ওই সময় তিনি তার এক বান্ধবীকে বলেন, ‘আমরা ভালা আছি তুমি তাইন ছিন্তা খরিও না’ তুমিতাইন আইওউ আমার ওনো, আইলে আমি ব্যবস্থা খরমু। (আমরা ভালো আছি তোমরা চিন্তা করো না, তোমরা চলে এসো আমার এখানে, রাজি থাকলে আমি তোমাদের সব ব্যবস্থা করব)। বান্ধবীর নেতিবাচক জবাবে রাজিয়া বলে, আমার লাগি তোমরা দোয়া খরিও আর ফোন দিতামনায়, তুমাতান সমস্যা ওইতো ফারো। (আমার জন্য দোয়া করো আর ফোন দেবো না কারণ এতে তোমাদের সমস্যা হতে পারে)।
সূচনা করে সামিয়ূন : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা আইএসের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছে এ বিষয়টি নজরে আসে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় সামিয়ূন নামে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। সামিয়ূন কথিত আইএসের জন্য কর্মী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এসেছিল। ওই বছর মে মাসে তার মাধ্যমে ঢাকার মিলিটারি ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমানসহ কয়েকজন সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দেয়। সামিয়ূন বর্তমানে কারাগারে আছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা : প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিষয়ে সতর্ক করে বেশ কিছুদিন আগেই পুলিশ সদর দফতরে একটি চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্র্রণালয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইয়েমেনসহ আইএস অধ্যুষিত এলাকায় বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক অবস্থান করছেন। সেখানে প্রবাসীদের মধ্যে কেউ স্বেচ্ছায় আইএস মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অথবা অর্থসহ বিভিন্ন প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে অথবা বাধ্য হয়ে আইএসে যোগদানসহ তাদের পক্ষে কাজ করছে। চিঠিতে এ ধরনের শংকা ব্যক্ত করা হয়। এসব দেশ থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের কেউ আইএসের পক্ষে কাজ করেন কিংবা স্বার্থ হাসিল করতে একই মতাদর্শের জঙ্গি সংগঠন সৃষ্টি অথবা বাংলাদেশে বিদ্যমান বিভিন্ন জঙ্গি, চরমপন্থী সংগঠনের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াস চালাতে পারেন। এভাবে তাদের মাধ্যমে দেশের ভেতরে আরও জোরালো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটনসহ সরকারবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কার্যক্রম ও নজরদারি অব্যাহত রাখতে বলা হয় চিঠিতে।