খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ১৯ আগস্ট ২০১৬: আজকাল লোককে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখা যায়। সাধারণত দক্ষতার ঘাটতি বলতে বুঝায় নিয়োগদাতারা তাদের কর্মীদের দিয়ে যা করাতে চান এবং কাজে যোগদানের পর কর্মীরা বাস্তবে তার কতটুকু করতে পারেন তার পার্থক্যকে।
কোনো একজন ম্যানেজার বলতে পারেন, “আমার কর্মীরা সব অসাধারণ। কিন্তু আমি এমন একজনকেও খুঁজে পাইনি যিনি উচ্চ-পর্যায়ের কাস্টমার সার্ভিস বোঝেন।”
সমস্যাটি এখানেই। দক্ষতার ঘাটতি মূলত একটি কাল্পনিক বিষয়। একজন ম্যানেজার বললেন তারা এমন কাউকে খুঁজছেন যিনি আকাশে উড়ে উড়ে ইতালিয়ান অপেরা বাজাবেন। অথচ তারা নিজেরাও জানেন বাস্তবে এই ধরনের লোক পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ শক্তিশালি কর্পোরেট লিডাররা বাস্তব জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেই কাজ করেন।
তারা প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেন; বাস্তবতার খুব কাছাকাছি থাকার জন্য। যে কম্পানি তার কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ করবে ধরে নিতে হবে তারা বাস্তবতার সঙ্গে এই যোগাযোগ হারিয়েছে।
কোনো কম্পানি কর্মীদের দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে সরাসরি অভিযোগ করতে পারে না। কারণ প্রকৃত প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করে তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলার দায়িত্ব কম্পানিগুলোর ওপরই বর্তায়। পৃথিবীতে জন্মায় না এমন কোনো খাদ্য শস্য থেকে যদি আমরা সকালের নাস্তা তৈরির কথা ভাবি তাহলে আর আমাদের কখনোই সকালের নাস্তা খাওয়া হবে না? তার চেয়ে বরং বিকল্প কিছু চিন্তা করতে হবে।
তেমনি চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে কল্পিত প্রত্যাশিত দক্ষতার অভাব দেখে বিদ্যালয়গুলোর ওপর দোষ না চাপিয়ে বরং কম্পানিগুলোর নিজেদের দিকেই আঙ্গুল তোলা উচিৎ। টাউন, কাউন্টি এবং স্টেটের কর্পোরেট সিটিজেন হিসেবে আমরা নিজেরাই আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের কী শেখানো উচিৎ তার দেখভাল করার জন্য দায়ী। অন্যথায় কম্পানিগুলোকে নিজেরাই বিদ্যালয় স্থাপন করে শিশুদের যা শেখানো দরকার তা শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে।
আমরা অভিযোগ করতে পারি না, বিদ্যালয়গুলো আমাদের কাছে নতুন কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ভুল কাঁচামাল পাঠাচ্ছে। নেতৃত্ব এমন নয়। কর্মস্থলের প্রকৃত নেতারা তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ইনপুট এবং আউটপুট এর দায়-দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে নেন। তবে আবহাওয়া এবং ভূরাজনীতির দায় হয়তো তাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
দ্রুততর হওয়া মানেই উন্নততর, এটাই আমাদের ব্যবসার বিশ্ববীক্ষা। দ্রুততার মানে হলো বিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী সরবরাহ করতে না পারলে বরং কম্পানিগুলো নিজেরাই কর্মীদেরকে তাদের চাহিদা মতো দক্ষতা সম্পন্ন করে তুলবে। দক্ষতার ঘাটতির অভিযোগ না করে বরং কম্পানিগুলোর উচিৎ নতুন কর্মীদেরকে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করা। যেন তারা স্বাধীনভাবে, স্বপরিচালনায় এবং চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে পারেন।
আর এখানেই সকলের সবচেয়ে মারাত্মক দক্ষতার ঘাটতিটি নিহিত। আমাদের কর্মীদের মাঝে নিজেদেরকে একটি অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে ভাবার আত্মসচেতনতা খুবই কম বা একদমই নেই। অন্যদিকে রয়েছে আমরা এই মুহূর্তে যে দুনিয়ায় বাস করছি তার বিদ্যমান বাস্তবতা। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে যে ঘাটতি বিরাজমান সেটাই আসলে ওই দক্ষতার ঘাটতি।
আপনি যদি আপনার কর্মীদেরকে দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্য উপকারী হবে এমন কিছু শেখাতে চান তাহলে তাদেরকে শেখান কী করে তারা নিজেদের কর্মজীবনকে ব্যবসার মতো করেই গড়ে তুলতে পারবেন। তাদেরকে এই শিক্ষাই দেন কী করে তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মজীবন পরিচালিত করতে পারবেন।
প্রতিটি কর্মজীবি লোকেরই এখন উদ্যোক্তাসুলভ মানসিকতার অধিকারী হওয়া উচিৎ। কারণ এই মানসিকতার অভাবেই এবং নিজেদের চারপাশের বিদ্যমান বাস্তবতার চাপেই কর্মজীবি লোকেরা নিরুৎসাহিত হন এবং আর্থিক দিকে থেকে নিম্ন মানের ক্যারিয়ারে আটকে থাকেন।
বাস্তব দুনিয়া এবং প্রতিভার বাজার থেকে ওই বিচ্ছিন্নতাই কর্মজীবি লোকদেরকে কর্মস্থলে আরো কম সক্রিয় এবং চাকরি চলে গেলে পুনরায় নিজের কর্মসংস্থানে অক্ষম করে তুলছে। আমাদের কর্মীদের বেশিরভাগের মধ্যেই প্রতিষ্ঠান বা নিজেদের ভবিষ্যত সম্পর্কে দূরদৃষ্টি নেই। যা কারো জন্যই এটা স্বাস্থ্যকর নয়।
এখন আর এমন কেউ কি আছেন যিনি পরের বছর এই একই সময়ে তিনি কোথায় কর্মে নিযুক্ত থাকবেন তা না জেনেই বালিশে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন? আমাদের বেশিরভাগই সেকেলে ধ্যান-ধারণার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। আমরা একটি চাকরি নেই। এরপর আমাদেরকে যা করতে বলা হয় শুধু তা করি। তারপর চাকরিটি পাঁচ থেকে দশ বছর বা আরো বেশিদিন করি। কিন্তু এখন আর এমনটা সম্ভব নয়। সেদিন চলে গেছে!
এখন সবকিছুই একটু ভিন্ন। এখন আমরা সকলেই উদ্যোক্তা। নিজের জন্যই কাজ করি বা অন্যের জন্য করি তাতে এই বাস্তবতায় কোনো হেরফের হয় না।
নিজেদেরকে এবার নতুন সহস্রাব্দের অর্থনৈতিক পরিবেশের জন্য মানানসই করে গড়ে তুলতে হবে আমাদের। বেশিরভাগ কর্মজীবিই জানেন না কীকরে নিজেদের ব্র্র্যান্ডিং করতে হয় বা কীকরে কর্মজীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ জীবন দক্ষতা; যেমনটা গাড়ি চালানো বা বিল প্রদানও। কর্মক্ষেত্র ছাড়া এসব আমরা আর কোথা থেকে শিখব?
যখন কোনো কর্মীকে বলা হয়, কম্পানির আভ্যন্তরীণ নীতি-নির্ধারকরাই সর্বেসর্বা। আর তিনি যে কম্পানিতে কাজ করছেন নিজেকে সে কম্পানির সিইও হিসেবে কল্পনা না করাটাই উত্তম। এবং তাকে যা বলা হবে শুধু তা করতে হবে; তখন আসলে ওই কর্মীকে এবং কম্পানির নিজেকেও আঘাত করা হয়। এর মাধ্যমে আমরা আসলে আমাদের নিজেদের দলের লোকদেরই চোখে ঠুলি পরিয়ে দেই।
অথচ আমাদের জন্য উচিৎ কাজটি ছিল কর্মীদেরকে নিজেদের কিউবিকল ছাড়িয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করার শিক্ষা দেওয়া। এতে প্রতিষ্ঠানের নিজেদের কর্মপ্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়। আমরা হয়তো বলি আমাদের প্রতিটি কর্মীকেই নিজেদেরকে ব্যবসার মালিক হিসেবে ভাবতে হবে। কিন্তু প্রতিটি মানব সম্পদ নীতি এবং ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি সম্পূর্ণ উল্টোটি উৎসাহিত করে।
আমাদের নীতি এবং চর্চাগুলোই লোককে নিজেকে ব্যবসার মালিক হিসেবে ভাবতে নিরুৎসাহিত করে। তারচেয়ে বরং তাদেরকে যা করতে বলা হয় শুধু তা করার জন্যই উৎসাহিত করে। এই ধরনের চিন্তা কী করে উদ্ভাবন, সহযোগিতা এবং নতুন যুগান্তকারী ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি করবে?
লোককে নিজেদের ক্যারিয়ার নিজে নিজেই গড়ে তোলার শিক্ষা দিলে আপনার এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাশীলতা তৈরি হবে। আর এর ফলে প্রতিটি কর্মীর মধ্যে আত্মবিশ্বাসও গড়ে উঠবে।
লোককে নিজেই নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়ার অর্থ হলো একধাপ পিছিয়ে গিয়ে তাদেরকে এই কথা বলে দেওয়া যে, “আমি এই কম্পানিটি আমার জানা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতিতে চালাচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে তা আমার জানা নেই। আমি এই নিশ্চয়তা দিতে পারি না যে, আগামী একবছর পরেও আপনি এখানে কাজ করতে থাকবেন। নিজেও আমি এখানে থাকবো কিনা তাও নিশ্চিত নয়; যদিও আমার চলে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। এবার আপনি আমাদের ব্যবসার পরিকল্পনাটি জানেন।
যে কোনো পরিবেশেই অনিশ্চয়তা থাকে এবং আমাদের এখানেও একই অবস্থা। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের তৈরি করতে হবে। যাতে যে কোনো পরিবেশে গিয়েই আমরা নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারি। এখানে কোনো বদল ঘটলে নতুন কাজ খুঁজে নেওয়ার জন্য আমাদেরকে তৈরি থাকতে হবে।
ব্যবসার দুনিয়া সম্পর্কে গড়পড়তা বুঝের চেয়ে আমাদেরকে একুট বেশিই বুঝতে হবে। আমাদের সকলকেই মুক্ত ব্যবসার মতো করে সক্রিয় থাকার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কারণ আমরা আসলে সেরকমই। আপনার ক্যারিয়ারই আপনার ব্যবসা।”
এখানেই আসলে আমাদের দক্ষতার প্রকৃত ঘাটতিটি নিহিত। এটাই এখন সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ। কারণ কোনোমতে একটি চাকরি যোগাড় করতে পারলেই আপনি ক্যারিয়ারে সফল হয়েছেন তা বলা যায় না।
কম্পানিগুলোর উচিৎ তাদের কর্মীদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা। কারণ যখন আমরা আমাদের কর্মীদের সঙ্গে “এই চাকরি চলে গেলে আপনি কী করবেন?” এমন বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করার জন্য যথেষ্ট আস্থাভাজন হতে পারব তখনই আসলে আমরা বলতে পারব যে আমরা এবার সত্যিকার নেতা হতে পেরেছি।
আমরা আমাদের কর্মীদেরকে কাজের জন্য দক্ষ করে তোলার আগে মৌলিক এই প্রশিক্ষণটি দিয়েই শুরু করা উচিৎ। আপনিসহ প্রত্যেক কর্মীই এখন একজন উদ্যোক্তা। আর এখনই সময় কর্মজীবি লোকদেরকে তারা নিজেরাই কীভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার পরিচালনা করতে পারবেন সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া। যারা নিজেরাই নিজেদেরকে একটি কম্পানির সিইও হওয়ার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলেন আর যেসব কম্পানি তার কর্মীদেরকে একাজে সহায়তা করে তাদের সকলেই শক্তিশালি ও ক্ষিপ্রগতির এবং দ্রুতগামী হবে।