খো
লা বাজার২৪, সোমবার, ২২ আগস্ট ২০১৬: মাননীয় অর্থমন্ত্রী মাঝে মাঝেই চমকে দেওয়ার মতো কিছু কথা বলে ফেলেন। কিছুদিন আগে তিনি জানিয়েছেন যে, যেটাকে আমরা ঘুষ বলি সেটি নাকি আসলে ঘুষ না! তিনি বলেছেন যে “কোনো কাজ দ্রুত করে দেওয়ার জন্য টাকা দেওয়া-নেওয়াকে ঘুষ বলে আখ্যায়িত করা সঠিক নয়। এটি হলো নির্দোষ ‘স্পিড মানি’।” অর্থমন্ত্রীর এই ‘স্পিড মানি’ বিষয়ক ‘অমৃতবাণী’ আমজনতাকে ক্রোধান্বিত করেছে। দেশের লুটেরা গোষ্ঠীকে তা অবশ্য সন্তুষ্ট করেছে। যে দেশে চলছে লুটপাটের অর্থনীতি, সে দেশের অর্থমন্ত্রী যে এমন কথা বলবেন তা মোটেও অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়। মনে করার কারণ নেই যে তিনি একথা বেফাঁস বলে ফেলেছেন। আসলে, লুটপাটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সপক্ষে দার্শনিক যুক্তি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেই তিনি এমন একটি অভিনব তত্ত্ব দিয়েছেন।

‘রাজনীতি হলো, শেষ বিচারে, অর্থনীতিরই ঘনীভূত প্রকাশ’। মানব সমাজের ইতিহাস বিশ্লেষণ এ সত্যটিকে প্রমাণ করে। একটি দেশের অর্থনীতির মূল চেহারা ও চরিত্র কি প্রকারের, সেটিই সে দেশের রাজনীতির গতিধারার ক্ষেত্রে, এমনকি চলমান রাজনীতির বেশিরভাগ ঘটনাবলির ক্ষেত্রে মূল নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। অর্থনীতির চরিত্র যদি হয় ‘লুটপাটের’ তাহলে রাজনীতির মূল ধারার আদল ও বৈশিষ্ট্যও অনুরূপ চরিত্রসম্পন্ন হয়ে উঠতে বাধ্য। শুধু রাজনীতিই নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক, মনস্তাত্ত্বিক ইত্যাদি সমাজের উপরিকাঠামোর সবকিছুর মূল ধারাই অর্থনীতির মৌলিক চরিত্রানুসারে অবয়ব ও বৈশিষ্ট্য লাভ করে।
বহু যুগ ধরে দেশ চলছে ‘বাজার অর্থনীতির’ দর্শন ও ব্যবস্থার ভিত্তিতে। ‘বাজার অর্থনীতি’ অবধারিতভাবে জন্ম দিয়েছে ‘বাজার রাজনীতির’। লেন-দেন ও লাভ-লোকসানের বৈষয়িক স্বার্থবোধের বাণিজ্যিক মানদণ্ড সর্বত্র প্রসারিত। ‘দেশটা কার বশ? দেশ টাকার বশ’—এটিই চরম সত্য হয়ে উঠেছে। একদিকে উন্নয়নের ফিরিস্তি অন্যদিকে লুটপাটের তাক লাগানো ঘটনাবলি। এসবই এখন এদেশের প্রাত্যহিক খবর। ‘উন্নয়ন’ ও ‘গণতন্ত্রের’ মধ্যে দেশে কোন্টা বেশি প্রয়োজন—এ প্রশ্ন তুলে শাসক আওয়ামী সরকার বলছে, এখন আগে দরকার উন্নয়ন। পদ্মা সেতু, রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুেকন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র, উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, মেগা সুপার শপ, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল—মেগা সব প্রজেক্টের নেশা ধরানো বর্ণনা শুনতে শুনতে মানুষকে মোহগ্রস্ত করে রাখার চেষ্টা চলছে। এর ফাঁকে লুট হয়ে যাচ্ছে হাজার-লাখ-কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ, জনগণের সঞ্চয়, ব্যাংকের আমানত। রাজনৈতিক ক্ষমতা তথা রাষ্ট্র ক্ষমতা হয়ে উঠেছে এই লুটপাটের একটি প্রধান হাতিয়ার। নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ, কমিটিতে পদপ্রাপ্তি, চাকরিতে নিয়োগ-বদলি, টেন্ডার, স্কুল-কলেজে ভর্তি সবকিছুকেই এখন লেনদেনের ও ব্যবসায়িক কারবারে পরিণত করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চলছে সীমাহীন লুটপাট। একের পর এক প্রকাশ হয়েছে বিপুল পরিমাণের আর্থিক কেলেঙ্কারির সব কাহিনি। সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকই এসব লুটপাটের ঘটনার বাইরে নয়। দেখা গেছে যে, সব কয়টি কেলেঙ্কারিতে যুক্ত রয়েছেন সরকারি কিছু আমলা, ব্যাংকের পরিচালকমণ্ডলীর কতিপয় সদস্য, ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন সরকার ও শাসক দলের ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষ কিছু ব্যক্তি।
ঋণখেলাপির বিষয়টি ব্যাংকের সাথে যুক্ত বিষয় হলেও বাংলাদেশে এর ব্যাপক রাজনৈতিক সম্পৃক্তি রয়েছে। অর্থমন্ত্রীর মুখ থেকেই জানা গিয়েছিল যে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সিআইবি ডাটাবেজে সংরক্ষিত ঋণ তথ্য অনুসারে সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ১৬২ জন। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাইট-অফ বা অবলোপন (ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে আলাদা করে রাখা) বাদ দিয়ে খেলাপি ঋণ হলো ৫১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির পেছনে প্রধানত দায়ী হলো দলীয়করণ। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি প্রতিটি সরকারের আমলেই যারা ব্যাংকের পরিচালক হন তাদের যোগ্যতা ছিল, তারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক। সরকারি ব্যাংক বাঁচানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যাদের হাতে, সেই পরিচালকরাই লুটে খেয়েছেন ব্যাংকের হাড়-অস্থি-মজ্জাটুকুও। অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে দলীয় বিবেচনায় লোক নিয়োগ করা ঠিক হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সম্পর্কে এসব অভিযোগ বিএনপির আমলেও ছিল। এসব অভিযোগ এখনো বেড়েছে বৈ কমেনি। হলমার্কের মতো ভয়াবহ কেলেঙ্কারির পরও এ ব্যাপারে সরকারের টনক নড়েনি। উল্টো অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে, চার হাজার কোটি টাকা নাকি তেমন কোনো টাকাই নয়।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। অনেক ক্ষেত্রেই চলছে নিয়ন্ত্রণহীন লুটপাট। ‘রাজনৈতিক উপঢৌকন’ হিসেবে পাইকারিভাবে ব্যাংক খোলার অনুমতি বিতরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেকে মূলধন ছাড়াই ব্যাংকের মালিক বনে যাচ্ছে। ব্যাংকিং সেবা নয়, তাদের উদ্দেশ্য একটিই—জনগণকে প্রতারিত করে বেশুমার লুটপাট করা। ব্যাক টু ব্যাক ভুয়া এলসি (ঋণপত্র) এবং জাল কাগজপত্র বন্ধক (মর্টগেজ) রেখে ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করছে একটি লুটেরা মহল। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে এলসির কাগজপত্র তৈরি করে অন্য ব্যাংকে তা বিক্রি করে তুলে নিচ্ছে টাকা। তারা সুকৌশলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে নিজেরাই আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক সেজে ব্যাংকের টাকা লুটে নিচ্ছে। এছাড়া ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে তা ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে ঋণের আবেদন করছে।
একাধিকবার শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা সারাদেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। সরকার তার কোনো প্রতিকার করেনি। ফলে লাখ লাখ মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে। বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছে। দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন থাকার পরও ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার হচ্ছে। এখন নতুন দাওয়াই হিসেবে সরকার বেছে নিয়েছে ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক-কে জাতীয় সংসদে জবাবদিহিতার আওতায় আনার’ বিধান। মানুষ রসিকতা করে বলে সরকার ভূত তাড়াবে সরিষা দিয়ে, কিন্তু সরিষার ভূত সে তাড়াবে কী দিয়ে? কারণ ভোট ও ভোটারবিহীন এ সংসদে ২২৬ জন সদস্য কোটিপতি। তাদের সম্পদ ও সম্পদের উত্স নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। ২০০৮ ও ২০১৪’র নির্বাচনী হলফনামায় বিভিন্ন সাংসদের প্রদত্ত সম্পদের হিসেব থেকে মাত্র ৬ বছরে তাদের সম্পদ বৃদ্ধির যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা আলাদিনের চেরাগকেও হার মানায়।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্কালীন গভর্নর আতিউর রহমান দেশের টাকা পাচারের এক উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল যে ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে ১১৭ কোটি ডলার অর্থাত্ ৯ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যা ঐ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের ১১ শতাংশ এবং বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার ৭৮.৫ শতাংশ। ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ১৮০ কোটি ডলার, অর্থাত্ প্রায় ১৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি। এদিকে সে সময়ের সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সে দেশের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নাগরিকদের ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্রা আমানত হিসেবে জমা রাখা আছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে যে, এক বছরের ব্যবধানে আমানতের পরিমাণ বেড়েছিল এক হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ৩ জুলাইয়ের দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ২০০২ সাল পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক হাজার ৬০৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা এক লাখ ২৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে গেছে। ইউএনডিপি’র প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়। এভাবে স্বাধীনতার পর ৪২ বছরে ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ‘দেশের সম্পদ বিদেশে (পশ্চিম পাকিস্তানে) পাচার বন্ধ কর’— এই দাবিটি ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্লোগান। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও দেশের অর্থ পাচার হওয়া বন্ধ হয়নি। বরঞ্চ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। তাহলে একথা কি আজ বলা যায় না যে, বুর্জোয়া শাসকরা স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের একটি মূল লক্ষ্যকে এভাবে কার্যত ধূলিসাত্ করে ফেলেছে?
লুটপাটের এই টাকায় গড়ে উঠেছে কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, সুইস ব্যাংক, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বিলাসবহুল বাড়ি-এপার্টমেন্ট। নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়ে পড়ানো, নিয়মিত মৌসুমি শপিং করা, ব্যয়বহুল চিকিত্সা ইত্যাদির জন্য দেদারসে খরচ হচ্ছে এ টাকা। ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে এক কোটি ১৭ লাখ টাকার সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে যে কোনো বাংলাদেশিকে দেওয়া হয়ে থাকে ১০ বছর মেয়াদী মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা। মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ২০০২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ঐ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে দুই হাজার ৭৫৫ জন বাংলাদেশি। দেশ থেকে বাইরে পাচার হওয়া টাকার সর্বশেষ প্রামাণ্য তথ্যকে ভিত্তি করে আমি দু’সপ্তাহ আগে এই পত্রিকায়ই লিখেছি। তা থেকে বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ কি মাত্রায় ক্রমাগত বাড়ছে।
এখন চলছে সব মেগা প্রকল্পের জয়-জয়কার। চোখ ধাঁধানো সব প্রকল্প। কিন্তু এসব প্রকল্পের পেছনে ব্যয়ের হিসেব নিলে দেখা যাচ্ছে কী ভয়ঙ্কর লুটপাট হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে। এর একটি নজির গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার। মুম্বাইয়ে ১৬.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ইস্টার্ন ফ্রি ওয়ে নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৮৮ কোটি টাকা। কলকাতায় পরমা পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভারে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়েছে ৪৮ কোটি টাকা। বাটানগর ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। ২৪ এপ্রিল’১৩ মালয়েশিয়ায় ৫টি ১০.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়েছে ৫৭ কোটি টাকা। চীনে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড রোড নির্মাণে খরচ পড়েছে প্রতি কিলোমিটারে ৪৮ কোটি টাকা। আর যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ পড়েছে প্রতি কিলোমিটারে ২৪১ কোটি টাকা যা কিনা সেসব দেশের খরচের চেয়ে ৪/৫ গুণ বেশি। ফ্লাইওভার নির্মাণের ব্যয়ের ক্ষেত্রে সব দেশের শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। অথচ নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। এভাবে ফ্লাইওভারের নামে টাকা ‘ফ্লাই’ করে গিয়ে জমা হচ্ছে মুষ্টিমেয় লুটেরাদের হাতে।
কৃষক-শ্রমিকের উত্পাদন আর প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের টাকা এভাবে লুট আর পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাকিস্তানিদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্লোগান স্বাধীনতার পথ রচনা করেছিল। শোষিত বাঙালিরা প্রশ্ন তুলেছিল—‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’? এর উত্তর নিহিত ছিল- ‘স্বাধীনতায়’। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর ধনী বুর্জোয়া শ্রেণির শাসন-শোষণ ও লুণ্ঠনে অতিষ্ঠ হওয়ায় নতুন করে প্রশ্ন উঠছে—‘স্বাধীন বাংলায় লুণ্ঠন কেন’? এর উত্তর নিহিত আছে ‘সমাজ বিপ্লবে’। শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকার কারণেই এই লুণ্ঠন। এই অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে লুণ্ঠন বন্ধ করা সম্ভব নয়। দ্বি-দলীয় বুর্জোয়া ব্যবস্থাই হোক, কিম্বা সামরিক শাসনই হোক—প্রমাণ হয়েছে যে প্রচলিত অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা বহাল থাকলে সব শাসনই হয়ে ওঠে লুণ্ঠন সহায়ক।
অর্থনীতিতে বেশুমার লুটপাটের ফলে রাজনীতিতেও চলছে বাজারতন্ত্র, বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্বৃত্তায়ন এবং নীতিহীনতা। এর ফলে বাড়ছে অসুস্থ ও রুগ্ন রাজনীতির ভয়াবহতা ও বিরাজনীতিকীকরণের বিপদ। এসব প্রবণতা ‘গণতন্ত্রের’ সাথে শুধু অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয়, তা গণতন্ত্রের পরিপন্থি। লুটপাটই যেহেতু শাসকদের আসল উদ্দেশ্য তাই তার প্রয়োজনে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়া হবে—এটিই স্বাভাবিক। তাই এটি কোনো অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে, জনগণকে আজ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় পুলিশি রাষ্ট্রের চরিত্র ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে, ‘লুটপাটের’ বিরুদ্ধে ও ‘গণতন্ত্রের’ জন্য জনগণকে একই সাথে সংগ্রাম করতে হবে। জোট বা মহাজোট—এদের দুটোর কাউকে দিয়ে কিম্বা বিরাজনীতিক ওয়ান-ইলেভেনের ব্যবস্থা দিয়ে যে এ কাজ হবে না, সে কথা প্রমাণিত হয়েছে। তাই, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জনগণের সম্পদ লুটপাট বন্ধ করতে হলে জোট-মহাজোটের বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য দরকার শোষিত জনতার সচেতন ও সংগঠিত প্রতিরোধ। দরকার, বামপন্থার উত্থান।n লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)