খোলা বাজার২৪, শনিবার, ২৭ আগস্ট ২০১৬: কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত প্রত্যন্ত পোড়ার চর গ্রামে এক নির্মম ঘটনার সাক্ষি ওই এলাকার অধিবাসীরা। ভারতীয় এক প্রতিবন্ধী মা তার কোলের সন্তানকে এই চরে রেখে উধাও হয়ে যান। ঘটনার ৯ বছর পরও সেই মা তার সন্তানকে ফিরিয়ে নিতে আর আসেনি। ইউসুফ নামে এই শিশুটি এখন এক বাঙালী মুসলিম পরিবারে সন্তান পরিচয়ে বেড়ে উঠছে। চলতি বন্যায় এই শিশুটির খবর বানভাসীদের সহায়তার জন্য আসা বিভিন্ন লোকজনের নজরে আসলে শিশুটি লাইম-লাইটে চলে আসে। তাকে নিয়ে তৈরি হয় নানান গল্প। সোমবার ভোরে সরজমিন পোড়ার চরে গিয়ে শিশুটি, তার স্থানীয় অভিভাবক ও গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায় নেপথ্যের ঘটনা।
কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে যাত্রাপুর নৌঘাট। এর তিনদিকে ভারতীয় সীমানা। যাত্রাপুর নৌঘাট থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে দ্বীপচর গ্রাম পোড়ারচর। এর আশেপাশে রয়েছে আরো ৮ থেকে ১০টি চর। কোন কোন চর ভারতীয় চরের সাথে সন্নিবেশিত। পোড়ার চরে আড়াই শতাধিক পরিবারের বসবাস। ব্রহ্মপূত্র নদের বুকে গড়ে ওঠা এই চরে যাত্রাপুর নৌঘাট থেকে শ্যালো নৌকায় যেতে সময় লাগে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট। সোমবার ভোরে সেখানে গিয়ে কথা হয় স্থানীয়দের সাথে। তাদেরই একজন শরিফুল জানান, ২০০৮ সালের চৈত্র মাসের এক দুপুর বেলা। মাঠ থেকে কাজ শেষে তিনি বাড়ী ফিরছিলেন। বাড়ীর সামনে এক মা কোলে দেড় বছরের এক শিশুসহ ৭/৮ বছরের আরেকটি শিশুকে নিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন। তাদের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল তারা ক্ষুধার্ত। শরীফুল কথা বলতে চাইলে মা’টি হিন্দি ভাষায় আবোল-তাবোলভাবে কথা বলতে থাকেন। সাথের বড় ছেলেটি হিন্দিতে জানায় তার মা পাগোল, তারা ভীষণ ক্ষুধার্ত। শরীফুল ৩জনকে খাবার দিলে মা’টি নিজে কোন কিছু মুখে না দিয়ে শুধু ছেলেদের খেতে দেয়। সেদিন ছিল যাত্রাপুরের হাট। পোড়ার চরের অধিকাংশ মানুষ সেই হাটে যায়। শরীফুলও হাটে গিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ঘটনাটি জানায়। হাট থেকে ফিরে এসে দেখে মহিলাটি বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছে। সন্ধ্যায় মহিলাদের চেঁচামেচিতে লোকজনের ঘুম ভেঙে যায়। সবাই উঠে ঘটনাস্থলের কাছে গিয়ে শুনতে পান শিশুর কান্না। বাড়ীঘরের পিছনে একটু ফাঁকা জায়গা থেকে শিশুর কান্না ভেসে আসছে। এই চরের মাসুদ মৌলভী লোকজনকে সাথে নিয়ে দেখতে পান, কাশিয়া ক্ষেতের নীচে দেড় বছরের একটি শিশু তাড়স্বরে চিৎকার করছে। মাসুদ মৌলভী শিশুটিকে উদ্ধার করে গ্রামে নিয়ে আসেন। শিশুটিকে দেখে সবাই বুঝতে পারেন এ সেই প্রতিবন্ধী মায়ের সন্তান। সে হয়তো ফেলে রেখে গেছে। মূহুর্তে চারদিকে খোঁজাখুজি শুরু হয়। কিন্তÍ মা’টিকে আর খুজে পাওয়া যায়নি। মাসুদ মৌলভী শিশুটিকে ওই চরের মৃত: বাহেজ উদ্দিনের পূত্র গৃহস্ত সোহরাব মিয়ার কাছে গচ্ছিত রাখেন। পরদিন সকলে এক মাঝির মাধ্যমে জানা যায়, মহিলাটি সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে ৭/৮ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী নারায়ণপুরের নৌকায় চলে গেছে। শরিফুল পরদিন নারায়ণপুরে গেছিলেন মাকে খুঁজতে। কিন্তু সেই মাকে আর ফিরে পাওয়া যায়নি। পরে ইউপি চেয়ারম্যান ও থানা থেকে আসা পুলিশের লোকজন সোহরাবের বাড়ীতে শিশুটিকে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। নাম রাখা হয় ইউসুফ। এই নামেই বড় হচ্ছে শিশুটি। বর্তমানে সে ওই চরে খেয়ার আলগা প্রি এন্ড কমিউনিটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে।
বর্তমান শিশুটির অভিভাবক সোহরাব মিয়া (৭০) জানান, ইউসুফকে আমি পিতৃ¯েœহে লালন-পালন করছি। অন্যান্য সন্তানদের মতো তাকে দেখি। আমার সন্তানরা তাকে নিজের ভাইয়ের মতো আদর করে। আমার ৪ ছেলে সুলতান, দেলোয়ার, সোনামিয়া ও সফিকুল এবং একমাত্র মেয়ে সাজেদাকে বিয়ে দিয়েছি। ইউসুফকে নিয়েই এখন আমাদের তিন জনের সংসার। আমার ৩ একরের মতো আবাদি জমি ছিল। গত ২/৩ বছরে সেগুলো নদীতে ভেঙে গেছে। বর্তমানে একবিঘা বসতবাড়ী ছাড়া আমার আর কিছু নেই। অনেক কষ্টের মধ্যে থেকেও এই ছেলেকে আমরা কষ্ট দেইনি। অনেকেই ইউসুফকে চেয়েছিল। কেউ কেউ জোড় করেছিল তাকে পেতে। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করেছি এর প্রকৃত অভিভাবক ছাড়া কাউকেউ দিবোনা। বর্তমানে ইউসুফকে নিজের ছেলে মনে করি। আপনারা দোয়া করবেন একে যেন মানুষের মতো মানুষ করতে পারি। আমরা ইউসুফের সাথে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু সে আমাদের দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল ছেলেটি। কোন কথা বলল না। সবাই বলল, ও বাইরের লোক দেখলে ভয় পায়।
সোহরাব মিয়ার স্ত্রী আয়েশা বেগম জানান, পোলাডারে বুকে পেটে মানুষ করছি। হারাডা দিন মায়ের চারপাশে থাকে। হে বাবা-মায়েরে ছাড়া থাকতি পারেনা।
কথা হল যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকারের সাথে। তিনি বললেন, ২০০৮ সালে ছেলেটিকে ফেলে তার মা চলে যায়। পরে ইউনিয়ন পরিষদ ও থানার পুলিশসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গ্রাম্যভাবে বৈঠকে সোহরাব মিয়ার জিম্মায় শিশুটিকে রাখা হয়। যেহেতু অনেক খুজেও শিশুটির মাকে পাওয়া যায়নি, সেজন্য সোহরাব মিয়াই তাকে পিতৃ¯েœহে লালন-পালন করছে।