Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলা বাজার২৪,রবিবার, ২৮ আগস্ট ২০১৬: ২০৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিটি করপোরেশন এলাকায় আনুমানিক ১৪ লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত রংপুরে এখন সচল সিনেমা হলের সংখ্যা মাত্র একটি। নাম শাপলা টকিজ।
লক্ষ্মী টকিজ অথচ দেড় যুগ আগেও এ রংপুর শহরে সিনেমা হল ছিল ১০টি। সেগুলো হচ্ছে ওরিয়েন্টাল, রূপালী, লক্ষ্মী টকিজ, সেনা অডিটরিয়াম, বিডিআর হল, শাপলা টকিজ, দরদী হল, নুর মহল, চায়না টকিজ ও মিতালী হল। এ হলগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। চলচ্চিত্র ব্যবসা যখন জমজমাট ছিল তখন সিনেমা হল মালিকদের একটি সংগঠনও ছিল রংপুরে। এখন তা অস্তিত্বহীন। কথা বলার জন্য সমিতির কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায় না। কয়েক বছর ধরে চলচ্চিত্রে ধস নামায় সারা দেশের মতো মুখ থুবড়ে পড়েছে রংপুরের সিনেমা হল ব্যবসায়ও। এ কারণে হল মালিকরা চলচ্চিত্র ব্যবসা ছেড়ে বন্ধ করে দেন সিনেমা হলগুলো। এ মুহূর্তে ওরিয়েন্টাল, লক্ষ্মী হল জায়গার মালিকানা নিয়ে মামলাসংক্রাস্ত জটিলতায় তালাবদ্ধ হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। সামনে গড়ে উঠেছে কিছু চা-পান ও বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। নুর মহল ও দরদী সিনেমা হল গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। সেনা অডিটরিয়াম বন্ধ করে দিয়ে সেখানে আর্মি মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলাসহ ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। বিডিআর সিনেমা হল ভেঙে জায়গা খালি করা হয়েছে। একমাত্র সিনেমা হল শাপলা টকিজ চলছে কোনোভাবে। তাও প্রকৃত মালিক মাসুমের মৃত্যুর পর তার ভাই মিন্টু হলের দায়িত্ব নেন। কিন্তু হলের ব্যবসা ভালো না হওয়ায় শাপলা টকিজ ভাড়া দেয়া হয় কামাল হোসেন নামে ঢাকার এক চলচ্চিত্র প্রযোজকের কাছে। সেই শাপলা টকিজের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন শাহাবুদ্দিন নামে এক ম্যানেজার। তিনি ব্যবসার মন্দাভাবে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, আশা ছিল জেলার উন্নতমানের একমাত্র শাপলা সিনেমা হল ভালো চলবে। কিন্তু এর অবস্থা আরও খারাপ। এ একমাত্র সিনেমা হলকেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে আরও বলেন, টেলিভিশনের পর্দায় পরিচালক, প্রযোজক, নায়ক-নায়িকাসহ সংশ্লিষ্টরা প্রায়ই বলেন একটি সুস্থ ধারার পরিচ্ছন্ন ছবি নির্মাণ করেছি। একেবারেই মৌলিক গল্প। দর্শকের কাছে অনুরোধ করেন আপনারা সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখুন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচান। আগামীতে আরও ভালো ছবি উপহার দেবো। নির্মাতাদের এমন কথায় আস্থা রেখে দর্শকরা বুক বেঁধে সিনেমা হলে গিয়ে চরম হতাশা ও বিরক্তি নিয়ে বের হন। আর এ কারণেই চলচ্চিত্রের আজ এমন বেহাল। এসব গাল-গল্প আর নয়। মেধা-মনন ও অভিনয় দিয়ে নিজস্ব ধারায় বাস্তবমুখী চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।
তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, বর্তমানে তার শাপলা হলের যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে সিনেমা হল ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ ও ১৮ কর্মচারীর বেতন দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই শাপলা হল ভাড়া নিয়ে ভর্তুকি দিচ্ছে তার মালিক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘুরে ফিরে একই ধরনের নিম্নমানের সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ নকল ছবির প্রদর্শন সিনেমা হল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। তাছাড়া সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ বর্তমানে ভদ্রলোকের অনুকূলে নয়। সিনেমা হলের দর্শক এখন সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ। সঙ্গে রয়েছে নোংরা বিনোদনে আগ্রহী উঠতি বয়সের বখাটে যুবকের ভিড়। অথচ রংপুরের সিনেমা ও সিনেমা হলগুলো এক সময় কত জনপ্রিয় ও পরিচিত ছিল তার স্বাক্ষর কিন্তু এখনও সংস্কৃতির উর্বর এ ভূমির রয়েছে।

রংপুর শহরে এখনও লক্ষ্মী হলের মোড়, ওরিয়েন্টাল মোড়, দরদী মোড়, নুর মহল মোড়, বিডিআর মোড়, সেনা অডিটরিয়াম মোড়, শাপলা চত্ব্বর, চায়না মোড়সহ বিভিন্ন হলের মোড় নামে স্থান তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। রংপুর বুড়িরহাট এলাকার পঞ্চাশোর্ধ্ব বছরের শফিক সরকার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ৭০-৮০ দশকে কোন নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে তার টিকিট পাওয়া ছিল সোনার হরিণের মতো। টিকিট কাটতে গিয়ে কতবার মারামারিতে জড়িয়েছি। হাত কেটে গিয়েছে, পরনের কাপড় ছিঁড়ে গেছে। তবুও প্রিয় নায়ক রাজ্জাক, সোহেল রানা, ওয়াসিম, জাভেদ, আলমগীর, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল, ফারুক, শাবানা, ববিতা, কবরী, সুচরিতা, নতুন, অলিভিয়া, রোজিনার ছবি না দেখে বাড়ি ফিরিনি। তখনকার ছবিগুলো ছিল সামাজিক ও বাস্তবধর্মী। বর্তমান ছবি প্রসঙ্গে বলেন, নেই সেই পরিচালক, অভিনেতা ও গল্প। কি দেখতে যাবো! দেখার মতো সিনেমা এখন আর তৈরি হয় না। মূলাটোল এলাকার আবদুর রহিম বলেন, আগেরকার ছবিগুলো দেখার মতো ছিল। যা দেখে আনন্দ ও তৃপ্তি পাওয়া যেতো। স্টেশন এলাকার চল্লিশোর্ধ্ব ফরাজী কনা বলেন, এ সময়ে দেশীয় পরিচালকদের সৃজনশীলতা নেই। ভারতীয় বাংলা ও বিদেশী সিনেমার হুবহু বাংলা কপি দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। অযথা চিৎকার, মারামারি ও অশ্লীল নৃত্য ছাড়া এখনকার চলচ্চিত্র আকাশ/ নূরমহল আর কিছুই পাওয়া যায় না। আরমান, রাতুল, শরিফুল, জনি বলেন, প্রযুক্তির এ যুগে মান্ধাতা আমলের ছবি দেখে সময় ও টাকা খরচ করার কোন মানেই হয় না। এর চেয়ে অনেক ভালো ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় রিমোট কন্ট্রোল টিপে সিনেমা দেখা। চলচ্চিত্রের নামে বাংলাদেশ যা তৈরি হচ্ছে তা রীতিমতো বিরক্তিকর। এ প্রজন্মের তরুণরা মনে করেন সিনেমা হল ও দেশীয় চলচ্চিত্র রক্ষায় সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের যতœবান হওয়া দরকার। রংপুর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি নাট্য ব্যক্তিত্ব কাজী মো. জুন্নুন বলেন, এক সময় নতুন কি সিনেমা আসছে তা জানার জন্য দর্শকের মাঝে ব্যাকুলতা ছিল। পাশাপাশি গ্রাম থেকে কোন কাজে শহরে এলে মানুষ একটি সিনেমা দেখে যাওয়ার তাড়না বোধ করতো। এখন সেই দিন নেই। তিনি মনে করেন আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। সুস্থ্য চিন্তা চেতনায় মানুষকে শাণিত করতে চলচ্চিত্র শিল্পকে রক্ষা করা দরকার। এ কাজে সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাণকারী উভয়কে যতœবান হতে হবে। তবেই আমাদের চলচ্চিত্রের হারানো গৌরব ফিরে আসবে।