Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
14102416_1208720245868330_7377980455883629295_nখোলা বাজার২৪,সোমবার, ২৯ আগস্ট ২০১৬: ওরে বুকে নিয়া আমি হাসপাতাল থেকে বাইর হইছিলাম। আজ ওর এ কী চেহারা দেখলাম! কেন আল্লাহ আমারে এটা দেখাইলো!’ বলে কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের লাশঘর থেকে বের হলেন ইতি ও রিতা। ইতি রিশার বড় মামি ও রিতা মেঝো মামি।

কাঁদতে কাঁদতে ইতি বলেন, ‘আমার বিয়ের দুই বছর পর ওর (রিশা) জন্ম। ওরে আমি কোলের ভেতর নিয়া হাসপাতাল থেকে বের হইছিলাম। সেই রিশার আজ কী চেহারা দেখাইলো খোদা!’

বুধবার (২৪ আগস্ট) বেলা পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা (১৫) দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়। এরপর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার (২৮ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৮টায় মারা যায় রিশা।
সুরাইয়া আক্তার রিশা‘আমার নিজের সন্তান আছে। তাদের বড় করছি। কিন্তু আমি মামি হয়ে বলছি, রিশার মতো কোনও মেয়ে হয় না। আমার সন্তানরাও হবে না ওর মতো। এমন মেয়ে মরে গেল। মেরে ফেললো একটা বখাটে! এর কি কোনও বিচার হবে না! আমরা কি রিশা হত্যার বিচার পাবো না’ বলেই কাঁদতে থাকেন ইতি।

পাশে বসা মেঝো মামি রিতা বলেন, ‘রিশা খুবই মিশুক ছিল। ছোটকাল থেকে বড় করলাম। আর এখন এই অবস্থা! পরিবারের সবার বড়, অনেক আদরের মেয়ে ছিল রিশা!’

রিতা বলেন, ‘ঘটনার পরদিন যখন ওকে দেখার জন্য আসলাম, তখন ও শুধু আম্মু আম্মু করছিল। গত বৃহষ্পতিবার থেকে রিশার মা তানিয়া হোসেন মেয়ের পাশেই ছিলেন। কিন্তু আজ সে নিজেই অসুস্থ।’ ‘মেয়ের লাশ কেমনে দেখামু তারে’ বলেই চিৎকার করতে থাকেন রিতা।রিশার বাবা রমজান হোসেন‘গুণ্ডাটা আমার মেয়েটারে মারলো’ বলে বিলাপ করছিলেন রিশার বাবা রমজান হোসেন। ঘটনার আগের দিনও (বুধবার) স্কুল ভ্যানের পাশে ঘোরাঘুরি করছিল ওই গুণ্ডাটা। রিশা ওর মাকে সেই কথা জানিয়েছিল। ওর মা তখন বলেছে, তোর বাবাকে বলি। কিন্তু ও বলেছে, বাবা শুনলে টেনশন করবে। সে কারণে তারা আমাকে আর জানায়নি।’

‘আমি যদি এটা জানতাম, তাহলে আজ আমার মেয়েটারে হারাইতে হতো না। আমি থাকলে এ রকমটা হইতো না’ কাঁদতে কাঁদতে এ কথা বলেন রিশার বাবা রমজান হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ওরে নিয়ে আসতাম, আর নিয়ে যেতাম। ওর মা অসুস্থ। আর আমিও ঠিকমতো সময় দিতে পারতাম না। সে কারণে ভ্যান দেওয়া হয় মেয়েটারে।’

‘ভ্যানে না দিলে আমার মাইয়াটার এ অবস্থা হতো না’ বলে বিলাপ করেন রিশার বাবা রমজান হোসেন। বিলাপ করতে করতেই তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা চলার কারণে ভ্যান দেওয়ার পরও এই মাসে কেবল চারদিন ক্লাস করছিল রিশা। মেয়েটারে কেন আমি দিয়ে আসলাম না!’

রমজান হোসেন জানান, ‘পাঁচ থেকে সাত মাস আগে টেইলার্সের ছেলেটা রিশাকে ফোনে বিরক্ত করতো। সে কারণে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেই। এত মাস পরেও যে ওই ছেলে এমন রূপ ধারণ করবে, তা তো বুঝতে পারিনি।’ তিনি বলেন, আমি খেতে বসলেই আমাকে ঠাণ্ডাপানি মিলিয়ে দিতো রিশা।’

সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কান্না করে রমজান হোসেন বলেন, আল্লাহ, আমার মেয়েটারে নিয়া গেলা। আমার বাচ্চাটারে আমি কই পামু! দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে রিশাই বড়।

তিনি বলেন, ‘ঘটনার তিন/চারদিন আগেও পিৎজা খেতে গেলাম সবাইকে নিয়ে। রিশাই অর্ডার দিলো। সবাই মিলে খেলাম। তারপর অনেকক্ষণ বসে আড্ডা দিলাম। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমাদের খুবই ভালো সম্পর্ক। প্রতিমাসেই তাদের নিয়ে ঘুরতে বের হতাম আমি আর ওর মা। দিন শেষে আমার তিন সন্তান আমাকে বলতো, বাবা তোমাকে আজকের দিনের জন্য ধন্যবাদ। আমি বলতাম, তোমাদের সারাজীবনের জন্য ধন্যবাদ। আমাকে এখন কে বলবে এসব কথা। আমি কাকে বলবো আর!’সহপাঠীদের কান্নারিশার আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে রমজান হোসেন বলেন, ‘স্কুলের সহপাঠীরাই আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, রিশা আহত। তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে আসেন। তারপর আমরা এসে দেখি, মেয়ের শুধু চিৎকার করতেছে। ওর মাকে শুধু বলছে, টেইলার্সের ওই লোকটা আমাকে মারছে মা। পুলিশের কাছেও জবানবন্দি দিয়ে গেছে। আইসিইউতে আমার সামনে চোখ খুলেছিল। ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে দেখে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। শুধু বলেছি, বাবা তুমি ভয় পাইয়ো না। আমরা তোমার সামনে আছি। তখন হাত দুটো বাড়ায়ে দিলো। আমি আমার দুই হাত দিয়ে ওর দুইটা হাত ধরলাম। ওকে অভয় দিলাম। কিন্তু কী করতে পারলাম! মেয়েটারে বাঁচাইতে পারলাম না’ বলেই আবার শুরু হয় তার আহাজারি। কাঁদতে কাঁদতে রিশার বাবা বলেন, আমার মেয়েটার অপরাধ কী, সেটাই জানতে পারলাম না!’

রিশার বড় মামা মুন্না সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘টেইলার্সের ছেলেটা বর্তমানে দিনাজপুরে আছে বলে জানতে পেরেছি। ঘটনার পর পুলিশ টেইলার্সের মালিকরে ধইরা ছেড়ে দিলো। আর ওরে গ্রেফতারই করতে পারলো না। এদের খুঁটির জোর কোথায়, সেইটা আপনারা বাইর করেন প্লিজ।’

রিশার মা তানিয়া হোসেন বাদী হয়ে রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন বলেন জানান তিনি।

স্কুলের ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু করেছে বলে জানালেন রিশার বাবা রমজান হোসেন। তিনি জানান, রক্ত দেওয়া থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করেছে ওরা। রিশার বাবার বিলাপ শুনে ও রিশার মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে উপস্থিত সহপাঠীরা। সবাই মিলে রিশার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এ সময় তারা স্লোগান দেয়- ‘বিচার চাই, রিশা হত্যার বিচার চাই!’উইলস লিটলস ফ্লাওয়ার শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধমামলার বিবরণে জানা যায়, প্রায় ৬ মাস আগে মায়ের সঙ্গে ইস্টার্ন মল্লিকার শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে যায় রিশা। সেখানে একটি ড্রেস সেলাই করতে দেয় সে। পরে দোকানের রশিদে বাসার ঠিকানা ও তার মায়ের মোবাইল নম্বর দেয়। পরে সেই রশিদ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল খান (২৯) রিশাকে ফোনে উত্ত্যক্ত করতো। পরে ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দিলে ওবায়দুল স্কুলে যাওয়ার পথে রিশাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ার পর রিশাকে ছুরিকাঘাত করা হয়।

পরে ওই টেইলার্সে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ওবায়েদ দুই মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেছে।