খোলা বাজার২৪, বুধবার,৩১ আগস্ট ২০১৬: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ দেশের স্বার্থান্বেষী মহল যারা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের বদলে পুরস্কৃত করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছে তারাই এ দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের শিকড় ।
‘জঙ্গিদের বাঁচিয়ে রাখলে তাদের শিকড়ের খোঁজ পাওয়া যেতো’ বলে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের জন্য মায়াকান্না খালেদা জিয়ার কোথা থেকে আসে সেটাও আমার প্রশ্ন। এ দেশে জঙ্গীবাদ সৃষ্টির মূল শিকড় হচ্ছে খালেদা জিয়া। ’
তিনি বলেন, ‘শিকড়ের সন্ধানতো আর করা লাগে না, শিকড় নিজেই যখন কথা বলে ওঠে। তখন ওইদিকেই পাওয়া যাবে। ওইদিকেই পাওয়া গেছে। শিকড়টা কি ওইদিক থেকে (খালেদা জিয়ার) আসে কি-না সেইটা এখন তদন্ত করে দেখতে হবে।’
‘খালেদা জিয়া যাদের মন্ত্রী বানিয়েছেন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের ফাঁসিও হয়েছে। কাজেই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের ফাঁসি হয়েছে তাদের যে মন্ত্রী বানিয়েছে তার শাস্তি কি হবে সেটাও দেশবাসীকে ভাবতে হবে। আজকে দেশের মানুষের মধ্যে এই সচেতনতাই সৃষ্টি করতে হবে ওই জিয়া এবং খালেদা জিয়া- যারা যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্তদের মন্ত্রী বানিয়েছে তাদের বিচার প্রকাশ্যে জনগণের সামনেই হতে হবে’- বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর কৃষিদি ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ (উত্তর-দক্ষিণ) আয়োজিত জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে স্মরণসভায় এ কথা বলেন।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভাপতি আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি, যুগ্মৃসাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সভাপতি এ কে এম রহমতউল্লাহ এমপি, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন এবং মহানগর আওয়ামী লীগের দুই অংশের দুই সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও শাহে আলম মুরাদ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে দেশের মানুষের মধ্যে এই সচেতনতাই সৃষ্টি করতে হবে ওই জিয়া এবং খালেদা জিয়া- যারা যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজাপ্রাপ্তদের মন্ত্রী বানিয়েছে তাদের বিচার প্রকাশ্যে জনগণের সামনেই হতে হবে। কাজেই সেভাবেই আমাদের জনমত সৃষ্টি করতে হবে। আর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যখনই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের খুঁজে বের করে এবং সেই জঙ্গিরা যখন নিহত হয় তখন তাদের জন্য মায়াকান্না খালেদা জিয়ার কোথা থেকে আসে সেটাও আমার প্রশ্ন। তাদের কেনো মারা হলো, তাদের কেনো বাঁচিয়ে রাখা হলো না- এসব কথা কোথা থেকে আসে।’
শেখ হাসিনা বলেন, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের মদদ দিতে পারে, পুরস্কৃত করতে পারে, যারা যুদ্ধাপরাধীদের জাতীয় পতাকা দিয়ে মন্ত্রী বানাতে পারে, যারা খুনীদের ভোট চুরি করে সংসদে বসিয়ে বিরোধীদলের নেতা বানাতে পারে, যারা সব ধরনের সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, তারাই জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত- এটাতো আর দেখারও প্রয়োজন নেই। এটাতো সাধারণ মানুষ খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছে। কাজেই এদেরও রেহাই নেই। এদেরও বিচার ইনশাল্লাহ জনগণ বাংলার মাটিতে করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই আমরা সেই প্রতিজ্ঞাই নেবো, জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করবো এবং বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধামুক্ত এবং দারিদ্র্যমুুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা। এ কথা বঙ্গবন্ধুও সব সময় বলতেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলার সময় বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় কোর্টে তোলা হলেই বঙ্গবন্ধু বলতেন, যে কথা আইযুব খান তার ডায়েরিতে লিখে গেছেনÑ ‘যখন তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) কোর্টে নিয়ে আসা হতো তখন কোর্টে ঢুকেই বঙ্গবন্ধু বলতেনÑ জয় বাংলাদেশ।’
কত বুকের পাটা ছিল, কতখানি আত্মবিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর, উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এও বলতেন, ‘আপনারা আমার কি বিচার করবেন, আপনারা আপনাদের কাজ করে যান আমিও আমার কাজ করেই যাবো। বাংলার স্বাধীনতা আনবো।’
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন বন্দী অবস্থায় পাকিস্তানে ছিলেন তখন তাঁকে ফাঁসি দিতো পারেনি। কিন্তু ইয়াহিয়ার ফাঁসির আদেশ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকচক্র বাস্তবায়ন করলো। তারা আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাতেই বিশ্বাস করে না। আর জনগণের সমর্থন ছিলো বলেই আমরা ক্ষমতায় এসেছি। দেশকে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করেছি এবং যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করে যাচ্ছি। একজন করে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে আর একটু একটু করে শাপমোচন হচ্ছে বাংলাদেশের- উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে একমাত্র কারবালার ঘটনারই তুলনা চলে। আমরা (শেখ রেহানাসহ) যখন বিদেশে ছিলাম তখন হঠাৎ এ খবর (হত্যাকান্ডের) পাই। বিশ্বাস করতে পারিনি সে কথা। মানুষ একটি শোকই সইতে পারে না। আমরা যে এতগুলো আপনজন হারালাম, আমরা বিচারও চাইতে পারলাম না।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিচার চাই বলে ওই ঘাতকের দল একটি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে দেয়Ñ মামলা করা যাবে না, থানায় ডায়েরি করা যাবে না। ফলে তারা বহাল তবিয়তে থাকে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে সেসব অর্ডিন্যান্স বাতিল করেই ’৯৬ সালে এই বিচারের কাজ শুরুর মাধ্যমে জাতিকে পাপমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারায় বিচার আবার থমকে যায়Ñ যা পরবর্তীতে তাঁর সরকারই শেষ করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। অনেক হুমকি-ধামকি এসেছে, কিন্তু নতি স্বীকার করিনি। আমি জাতির পিতার কন্যা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কয়েকদিন আগে দেশ ছেড়ে ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থলে যাবার স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমিও মানুষ। যখন আমি ঢাকার মাটি ছেড়ে যাই তখন কামাল ও জামাল এয়ারপোর্টে ছিল। যখন ফিরে আসি তখন কামাল, জামাল, বাবা-মাকে খুঁজে বেড়াই। হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু তাদের ফিরে পাইনি। পেয়েছি হাজারো মানুষ। তাদের মাঝে খুঁজে পেয়েছি আমার মা-বাবা ও ভাইদের।’
১৫ আগস্টের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ সালে ওই হত্যাকান্ডের পর বারবার ক্ষমতার পালাবদল শুরু হয়। খুনি মোশতাক গাদ্দারি করেছে। সে এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। জিয়াউর রহমান আরেক খুনি, সেও এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত।’
তিনি বলেন, ‘খুনি মোশতাক কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়। তারপর তাকে সরিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। সেনা আইন ভঙ্গ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতায় আসে। বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে খুনিদের পুরস্কৃত করে। কি অদ্ভূত দেশে বাস করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানেই শেষ হয়নি। ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো। যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রথম সরকার গঠন করে ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে। তাদেরও হত্যা করেছিল জিয়াউর রহমান। এই হত্যাকান্ডের পর থেকে দেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়।’
জিয়াউর রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘নামে মুক্তিযোদ্ধা ছিল, নানা খেতাবও পেয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাজ কী করেছে? মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। যে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ছিল, মার্শাল ল’ অর্ডিনেন্স দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে এই জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা পশ্ন তোলেন, ‘খুনিদের (বঙ্গবন্ধুর) পুনর্বাসন করেন জিয়াউর রহমান। পঁচাত্তরের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী, তাদের পুনর্বাসন করেছে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা বানিয়েছে। সে (জিয়াউর রহমান) কী করে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের ভোটের অধিকার ছিল না। মার্শাল ল’ অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ সংশোধন করে জিয়া তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে রাজনীতি ও দল করার সুযোগ দিয়েছে। তাহলে সে কী করে মুক্তিযোদ্ধা, আর সে কী করে স্বাধীনতার স্বপক্ষ?’
যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনেন জিয়া মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানান, আবদুল আলীমকেও মন্ত্রী বানান।
তিনি বলেন, ‘কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানি পাসপোর্টেই তাকে দেশে আনা হয়। পরে খালেদা জিয়া তাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেন।’
জিয়াউর রহমান প্রসংগে অভিযোগে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯টি ক্যু হয়েছে। একেকটি ক্যু হওয়া মানেই সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের জীবন নিয়ে খেলা। হাজার হাজার অফিসার ও সেনিকদের সে হত্যা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের পরে আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। চার বছর পর্যন্ত তারা কারাগারে ছিলো। জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে তাদের যে ছিনিমিনি খেলা! হ্যাঁ-না ভোট, রেফারেন্ডাম, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনÑ প্রতিটি নির্বাচন ছিল প্রহসনের খেলা। সেখানে নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার কারও ছিল না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই নির্বাচনের রেজাল্ট হয়েছে। নির্বাচনকে নিয়ে খেলা তো সেখান থেকেই শুরু।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতাই দিয়ে যাননিÑ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষের মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সবই করে দিয়ে গেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায় সে পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই ১৫ আগস্ট তাঁকে হত্যা করা হয়। সংবিধান থেকে শুরু করে সবই তিনি করে দিয়ে গেছেন। আজ যেখানেই হাত দেই সেখানেই দেখি তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) চিন্তার প্রতিফলন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দেশের মানুষ সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলো। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ মানুষের অধিকার রক্ষায় আবার কাজ শুরু করে।
স্মরণ সভায় ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হবে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।