Tue. Apr 29th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

mir_quasem_hang_shadhinbangla24

খোলা বাজার২৪,রবিবার,০৪ সেপ্টেম্বর  ২০১৬:  মুক্তিযুদ্ধকালে আল বদর বাহিনীর কমান্ডার ও বর্তমানে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে।

আজ শনিবার দিবাগত রাত ১০টা ৩৫মিনিটে গাজীপুর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থায় আরও একটি ইতিহাস রচিত হলো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বাসস’কে মীর কাসেমের (৬৪) ফাঁসি কার্যকর করার কথা নিশ্চিত করেন। সকল বিধি বিধান মেনে এ রায় কার্যকর করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
জল্লাদ শাজাহানের নেতৃত্বে চারজন জল্লাদ কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে বলে কারাগারের একটি সুত্র জানায়।
আলবদর নেতার ফাঁসি কার্যকর করার খবর রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র মানুষের মধ্যে স্বস্তি নেমে আসে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শতশত মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস করতে থাকে। ঢাকা, বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এলাকায় স্বতস্ফুর্তভাবে শতশত মানুষ মিছিল নিয়ে আনন্দ উল্লাস করে। কাশিমপুরের কারাগারের সামনে সড়ক মহাসড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ আনন্দ উল্লাস করছে এবং তারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দেয়।
এদিকে সংবাদদাতা জানায়, মানিকগঞ্জে এই আলবদর নেতার লাশ দাফন ঠেকাতে জেলা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ মিছিল ও সমাবেশ করছে। তারা বলেন, এই যুদ্ধাপরাধীকে মানকিগঞ্জে কবর দিতে দেয়া হবে না।
মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী এই অপরাধীর লাশ প্রায় ২০ মিনিট ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে মরদেহ ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়। গাজিপুরের সিভিল সার্জন আলী হায়দার খান মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে লাশের সুরত হাল করা হয়। পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে দাফন করা হবে বলে তার স্ত্রী সাংবাদিকদের জানান।
রায় কার্যকরের আগে আজ সন্ধ্যায় মীর কাশেম আলীর সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে শেষ দেখা করে তার পরিবারের সদস্যরা।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এটি হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার ষষ্ঠ ফাঁসির রায় কার্যকর, যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিত করা হলো।
এ দন্ড কার্যকরের সময় আইজিপি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর জেলার নাশির আহমেদ, জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম, পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ, গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার খান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে লাশবাহী ৩টি এ্যাম্বুলেন্সও কারাগারে নিয়ে রাখা হয়।
কারা সূত্র জানায়, কারাগারে তাকে শেষ গোসল করানো হয়। মীর কাসেমকে তওবা পড়ান কারাগার মসজিদের ইমাম মুফতি হেলাল উদ্দীন।
দন্ড কার্যকরকে কেন্দ্র করে কাশিমপুর কারাগার ও এর আশপাশের এলাকায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ঢাকা ও গাজীপুরে ১০ প্লাটুন বিজিবিসহ বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। কারাগারে প্রবেশ পথে সাধারণের চলাচলে কঠোরতা আরোপ করা হয়। তবে গণমাধ্যমের কর্মীরা কারা ফটকসহ কারাগার এলাকায় নির্বিঘেœ দায়িত্ব পালন করে।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধী দায়মুক্তির পথ ঊন্মোচন হয়েছে।
রায় কার্যকরের আগে সর্বশেষ ধাপ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পান মীর কাসেম। প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরে আর কোনো বাধা না থাকায় এ দন্ড আজ কার্যকর করা হয়।
মীর কাসেম আলীর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে গত ৩০ আগস্ট আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ আপিল বিভাগের ১ নং বিচার কক্ষে জনাকীর্ন আদালতে এ আদেশ দেয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। ওই দিনই ২৯ পৃষ্ঠার এ আদেশ প্রকাশ করে আদালত। রায়ের অনুলিপি সুপ্রিমকোর্ট থেকে ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে কারাগারসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় পাঠানো হয় এবং ৩১ আগস্ট রায় মীর কাসেম আলীকে পড়ে শুনানো হয়।
গত ৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেছিলো আপিল বিভাগ। গত ৬ জুন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। রায় প্রকাশের পর সংক্ষব্ধ পক্ষ ১৫ দিনের মধ্যে রায় রিভিউ আবেদনের সূযোগ পান। সে অনুযায়ি মীর কাসেম আলী রায় রিভিউ আবেদন করেছিলেন।
আপিলের রায়ে বলা হয়, আসামি পক্ষে আনা আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয়েছে। এ মামলায় প্রসিকিউশন আনীত অভিযোগের মধ্যে ৪, ৬ ও ১২ নং অভিযোগ থেকে মীর কাশেম আলীকে খালাস এবং ২, ৩, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালে দেয়া দন্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। একটি অভিযোগে তার মৃত্যুদন্ড বহাল এবং অপর ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদন্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাশেম আলীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। মামলায় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশন আনীত ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলী দোষী প্রমাণিত হয়েছে। তবে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে এসব অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাকে খালাস (অব্যাহতি) দেয়া হয়। প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাকে ৭ বছর করে মোট ৪২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ১৪ নম্বর অভিযোগ ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এই ৮টি অভিযোগে তাকে সর্বমোট ৭২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। ১১ নম্বর অভিযোগে রয়েছে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ছয়জনকে আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ। এ অভিযোগে বিচারকরা সর্বসম্মতিক্রমে মীর কাসেমকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়। ১২ নম্বর অভিযোগে রয়েছে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ। ১১ ও ১২ নং অভিযোগ ছাড়া বাকি ১২টি অভিযোগই অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ মীর কাসেমের বিরুদ্ধে।
যে অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড আপিলেও বহাল রাখা হয়, অভিযোগ ১১: মুক্তিযুদ্ধকালে ঈদুল ফিতরের পরে একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দীন আহমদকে অপহরণ করে শহরের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যুবরণ করলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়। আজ এ রায়ই কার্যকর হলো।
মীর কাসেম আখ্যায়িত ছিলেন পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসেবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আল বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন মীর কাসেম। কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান। মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেয়া হয়েছিল ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দি শিবির ও টর্চার সেল। আল বদর কমান্ডার মীর কাসেম আলী মুক্তিযুদ্ধের পর ব্যবসায়ী ও জামায়াতের অন্যতম অর্থদাতা ছিলেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। তখন থেকে সে কারাগারে ছিলো।