খোলা বাজার২৪,বুধবার,০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬: হাসান খান: সিরীয় শরণার্থীদের জন্য সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি নিরাপদ এলাকা (ঝধভব তড়হব) সৃষ্টি করার জন্য আঙ্কারা গত ফেব্র“য়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ‘ইসলামিক স্টেট’-বিরোধী জোটকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে অঞ্চলে আসাদ সরকারের সহযোগী শক্তি রাশিয়া এবং অন্যদিকে আইএসবিরোধী বিভিন্ন সিরীয় কুর্দি বাহিনীর নজরদারি ও তৎপরতার কারণে তা এত দিনেও হয়ে ওঠেনি।
তাতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। কারণ তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়ার উত্তর সীমান্ত এলাকায় সিরীয় কুর্দি বাহিনী ইতিমধ্যে মানবিজ এলাকা থেকে আইএসকে বিতাড়ন করেছে। পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি) নামে কুর্দি বাহিনী সে অঞ্চলে দুই সপ্তাহ আগে একটি আক্রমণ পরিচালনা করে।
তা ছাড়া সে অঞ্চলে কুর্দিশ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) সেখানে ‘রজাভা’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে দাবি করেছে। তুরস্কের দৃষ্টিতে এ দুটি গ্রুপকেই নিষিদ্ধ কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) শাখা-প্রশাখা বলে প্রচার করা হয়। পিকেকে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে বহু আগেই তুরস্কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ অবস্থায় পিকেকে ৩০ বছর ধরে তুরস্কের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আনাতোলিয়া অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক তার ‘উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী সিরিয়ার কোনো স্থান বা শহরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাই কোনো কুর্দি গ্রুপের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নয়
। কারণ তুরস্কের মতে, কুর্দিরা ক্রমাগত সিরিয়া সীমান্তে তাদের তথাকথিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সীমানা বাড়িয়ে একদিন প্রতিবেশী তুরস্ক, ইরাক ও ইরানের কুর্দি অধ্যুষিত বৃহত্তর এলাকা নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারবে। এতে তুরস্ক ও সিরিয়ার সার্বভৌম অঞ্চল ও নিরাপত্তাব্যবস্থা তছনছ হয়ে পড়তে পারে। তা ছাড়া ইরাকের কুর্দিদের দৃষ্টি রয়েছে তেলসমৃদ্ধ ইরাকের এক বিশাল অঞ্চলের ওপর, যা বর্তমানে কুর্দিস্তান বলে পরিচিত। সেসব কারণে কিংবা কুর্দিদের বৃহত্তর নীলনকশা বাস্তবায়িত করতে গেলে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া ও ইরানের এক বিশাল অঞ্চল টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৩ সালে বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক আক্রমণ ও পরবর্তী ঘটনাগুলো সে সম্ভাবনার দুয়ার অনেকটাই খুলে দিয়েছে বলে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
গত ১৫ জুলাই তুরস্কে সংঘটিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটের ওপর আস্থা অনেকখানিই হারিয়ে ফেলেছেন।
তাই গত ২৫ আগস্ট ৪০টি তুর্কি সামরিক ট্যাংক ও দুই হাজার বিদ্রোহী সিরীয় সৈন্যের (ফ্রি সিরিয়ান আর্মি) সহায়তায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুরস্কের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিরীয় সীমান্ত দিয়ে এক আক্রমণ পরিচালনা করে সিরিয়া সীমান্ত শহর জারাব্লুস দখল করেন। আইএসকে হটিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ অঞ্চলে দখল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গি বিমান (তুরস্ক ঘাঁটি থেকে) আকাশ থেকে সহায়তা প্রদান করে বলে জানা গেছে। ফ্রি সিরিয়ান আর্মির বিদ্রোহী সদস্যরা জারাব্লুস অঞ্চল থেকে আইএসের বিভিন্ন স্থাপনা এবং বিভিন্ন ব্যানার কিংবা প্রচারসামগ্রী উড়িয়ে দেয়। তবে সেখানেই তারা থেমে থাকেনি। অর্থাৎ এ অঞ্চল থেকে আইএসকে উৎখাতই তাদের একমাত্র লক্ষ্য নয়।
তারা সে অঞ্চলে সিরীয় কুর্দি বাহিনীর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখার পক্ষপাতী নয়। সুতরাং ক্রমেই আরো উত্তরে অগ্রসর হয়ে এক বিশাল অঞ্চল নিয়ে সিরীয় উদ্বাস্তুদের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চল ও আশ্রয়স্থল নির্মাণই তাদের লক্ষ্য। সে কারণে কুর্দিদের (সিরীয়) কোনো পরিচয়েই শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকতে দেওয়া হবে বলে মনে হয় না। এতে নাখোশ যুক্তরাষ্ট্রের সমর কৌশলীরা। কারণ সিরিয়ায় আইএসবিরোধী অভিযানে স্থানীয় কুর্দিরাও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র তুরস্কের তুলনায় কুর্দিরা অতি তুচ্ছ হলেও এত দিন তারা একটি আশা নিয়ে আইএসবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল।
তাই যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষুদ্র মিত্র শক্তিটিকেও হতাশ করতে চায় না। কিন্তু তুরস্ক সেটি মানতে রাজি নয়। তাতে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে বলে তুরস্ক সরকারের আশঙ্কা। কারণ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন সিরীয় কুর্দিরা তুরস্ক, ইরাক ও ইরানের কুর্দিদের সঙ্গে মিলে তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মাঠে নামতে পারে। তাতে জঙ্গিবাদী ও নিষিদ্ধ পিকেকের হাত আন্তর্জাতিকভাবেই অনেক শক্তিশালী হয়ে যাবে।
তুরস্কের সিরিয়া অভিযান ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আসন্ন জি-২০ সম্মেলনের একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মিলিত হবেন বলে জানা গেছে। তা ছাড়া তুরস্কের সাম্প্রতিক সময়ে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান, উপর্যুপরি পিকেকের নাশকতামূলক হামলা এবং সিরিয়ায় একটি ‘নিরাপদ জোন’ সৃষ্টির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আঙ্কারায় এসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
তুরস্কের কারাকামিকা শহরাঞ্চলের নিকটবর্তী সিরীয় সীমান্তবর্তী শহর জারাব্লুস আক্রমণের বহু আগে থেকেই তুরস্ক ও সিরিয়ার এ সীমান্ত বহু কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মূলত এখান দিয়েই অধিকাংশ শরণার্থী তুরস্কে প্রবেশ করে। তা ছাড়া এ সীমান্ত দিয়েই আবার অনেকে সিরিয়ায় গমন করে থাকে। সুতরাং তুরস্ক এ অঞ্চল অর্থাৎ সিরিয়ার জারাব্লুসসহ অন্যান্য স্থান কোনো মতেই কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণে যেতে দিতে রাজি না।
সিরিয়া সংকট নিয়ে গত সপ্তাহে জেনেভায় এক জরুরি আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট জন কেরি ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লেভরভ। আলেপ্প নগরীতে বিভিন্ন গ্রুপের এবং বিশেষ করে আইএসের বিভিন্ন অবরোধের ফলে আটকে পড়েছিল অসংখ্য শিশুসহ সিরীয় নাগরিকরা। তাদের ছিল না কোনো প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি ওষুধপত্র।
গণমাধ্যমসহ সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এ যুদ্ধের ব্যর্থতার জন্য শুধু বাশার আল-আসাদ নন, রাশিয়া, ইরান এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে নানাভাবে দায়ী করেছে। সিরিয়ায় মানবতার এ বিপর্যয়ের জন্য এখন প্রায় সারা বিশ্বই বৃহৎ শক্তিকে নানা অপবাদ দিচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিদায়ের দিন ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। অথচ বিভিন্ন সংকট ও জটিলতার কারণে এখনো সিরিয়া সমস্যার কোনো সমাধান হলো না। বাশার আল-আসাদকে কিভাবে ক্ষমতা থেকে সরানো যায় এবং কিভাবে সিরিয়ার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা যায়—তার কোনো সদ্গতি হলো না এখনো।
শেষ পর্যন্ত সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষা করা যাবে কি না তারও কোনো হদিস মিলেনি এখনো। ২০০৩ সালে বুশ-ব্লেয়ার ইরাক আক্রমণ করলেও ২০১১ সালে সিরিয়ায় রাজনৈতিক বিক্ষোভ চরমে উঠতে শুরু করে। পারমাণবিক স্থাপনা নিয়ে ইরান আক্রমণের ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা দূরে থাকতে পেরেছেন, এটি তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলে উল্লেখ করলেও ইরাক কিংবা সিরিয়ায় তিনি মার্কিন সৈন্য পাঠাতে কোনো মতেই রাজি হননি।
ওবামার যুদ্ধবিরোধী নীতির কারণে অতি দ্রুততার সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান না হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা দীর্ঘস্থায়ী কৌশলের পথে এখন অতি ধীরগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। তাতে খুশি ইহুদিবাদী ইসরায়েল। কারণ তারা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোকে শুধু দুর্বল নয়, ভেঙে টুকরো টুকরো করতে চেয়েছিল। সে কারণেই হয়তো আইএসের সৃষ্টি এবং কুর্দিদের স্বাধীন ও বৃহত্তর কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ।
ইহুদিবাদীদের প্রভাবান্বিত যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস একদিকে জঙ্গিবাদকে ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন সময় মায়াকান্না করলেও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ততটা উৎসহী নয় বলে গণমাধ্যমের বিভিন্ন অংশে অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় ইরাক পূর্ণোদ্যমে তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে আইএসকে উচ্ছেদের অভিযানে আবার নিয়োজিত হয়েছে। ইরাক সরকারের দৃষ্টি এখন তেলসমৃদ্ধ বিভিন্ন অঞ্চল এবং বিশেষ করে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী মসুল পুনরুদ্ধারের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে।
ইরাকের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো দেশের উত্তরাঞ্চলে, যেখানে প্রচুর কুর্দিদের বাস। ইরাকের জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৬০ লাখ নাগরিক কুর্দি। তারা উত্তর ইরাকের তিনটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলটি কুর্দিস্তান নামে পরিচিত।
তা ছাড়া কিরকুক, মসুল ও খানাকিনেও প্রচুর কুর্দি সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। প্রায় তিন লাখ কুর্দি রাজধানী বাগদাদ ও পাঁচ লাখ মসুল এবং তার আশপাশে ও দক্ষিণে আরো এক লাখ কুর্দি বাস করে। কুর্দিদের নেতা মোস্তাফা বারজানি। স্বাধীনতার দাবিতে তারা এখন অটল।
১৯৬০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বারজানি ইরাকের বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তবে ১৯৭০ সালের দিকে সরকার কুর্দিস্তানের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং তাদের পর্যায়ক্রমে স্বায়ত্তশাসন দিতে রাজি হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের চার বছরের মধ্যে তাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও ইরাক সরকার শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি। ইতিমধ্যে ইরাক সরকার এ অঞ্চলে এক ‘আরবীকরণ’-এর সিদ্ধান্ত নেয় এবং তেলসমৃদ্ধ কুর্দি এলাকা কিরকুক ও খানাকিনে প্রচুর আরবদের স্থানান্তর করে।
কুর্দিরা সুন্নি মতাবলম্বী মুসলিম হলেও আরব নয়। তারা নিজেদের কুর্দি সম্প্রদায় হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে কুর্দিরাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্প্রদায়, যারা এখনো স্বাধীনতা পায়নি। ইরাক সরকার বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে অত্যন্ত অমানবিক আচরণ করেছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তেলসমৃদ্ধ কিরকুকসহ কুর্দিস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দুই লাখ কুর্দিকে দেশের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কুর্দিস্তানের পেশমার্গা সৈন্যরা তাদের সাহস ও যুদ্ধ কৌশলের জন্য অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করেছে। বর্তমানে তারা কুর্দিস্তান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে আইএসকে বিতাড়নের ব্যাপারে অত্যন্ত সুনাম অর্জন করেছে। পেশমার্গা কুর্দি যোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মহিলা সদস্যও রয়েছে। ইরাকের কুর্দিরা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম ও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের স্বাধিকার আদায়ের প্রত্যাশায়, যা এখন তাদের মধ্যে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জন্ম দিয়েছে। বর্তমান আইএসবিরোধী যুদ্ধ শেষ হলে তারা তাদের স্বপ্নের একটি সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের চারটি স্বাধীন দেশে বিশাল কুর্দি জনগোষ্ঠীর বাস। তার মধ্যে বর্তমানে তুরস্কে প্রায় দেড় কোটি, ইরানে ৬০ লাখ, ইরাকে ৫০ থেকে ৬০ লাখ এবং সিরিয়ায় ২০ লাখসহ মোট দুই কোটি ৮০ থেকে ৯০ লাখ কুর্দি জনসংখ্যা ধরা হয়। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি হতে পারে বলেও ধারণা করা হয়। কারণ ষাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে কুর্দিরা তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ বিভিন্ন অধিকার নিয়ে ক্রমে ক্রমে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুললে উল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোতে তাদের ওপর বিভিন্ন নির্যাতন ও নিষ্পেষণ নেমে আসে।
ইরাকে ১৯৬০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে কুর্দিদের ওপর কঠোর আঘাত নেমে এলে ইরাকি কুর্দিস্তান ও তার আশপাশের অনেক বড় শহর নগর থেকে কুর্দি জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জীবিকার সন্ধানে জার্মানিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এর পাশাপাশি তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের আনাতোলিয়া থেকেও প্রচুর কুর্দি জার্মানি, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি নগরীতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তবে যেখানেই যাক, তাদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন থেমে থাকেনি।
অথচ আজও স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি বিশ্বের এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম সম্প্রদায় হচ্ছে কুর্দিরা। মধ্যপ্রাচ্যের উল্লিখিত চারটি মুসলিম রাষ্ট্রের বাইরেও আর্মেনিয়া, জর্জিয়া ও রাশিয়ায়ও রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কুর্দি সম্প্রদায়ের মানুষ। ইরাকের কুর্দিস্তানকে কেন্দ্র করে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ২০০৩ সালে বুশ-ব্লেয়ারের ইরাক আক্রমণের পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল।
তারপর আইএসবিরোধী যুদ্ধে ইরাকি কুর্দিদের পেশমার্গা যোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ও অবদান সে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জল্পনা-কল্পনাকে আরো শক্তিশালী করেছিল। তবে কুর্দিস্তান এলাকার তেলসম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে ইরাকের বিভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে। তারা ইরাককে ভাগ করতে চায় না। অন্যদিকে তুরস্ক, ইরান ও সিরিয়াও তাদের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বজায় রাখতে চায়।
এ অবস্থায় কুর্দি সম্প্রদায়ের বহুদিনের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিকে আর কিভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে, তা নিয়ে বিশ্বের সর্বত্রই গণমাধ্যমে এখন নানা আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। তুরস্কে পিকেকে সমর্থিত আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন সময় নানা হিংসাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্ককে ভাগ করা যাবে না। এক দেশ, এক জনগোষ্ঠী ও এক পতাকা নিয়েই টিকে থাকবে তুরস্ক।
তুরস্কের সভ্যতা, গৌরব ও ঐতিহ্যকে ভাগ করা যাবে না। তুরস্কের একটি পতাকাই সারা দেশবাসীর প্রতিনিধিত্ব করবে। কিন্তু তার পরও সিরীয় কুর্দিদের বিভিন্ন তৎপরতা নিয়ে দেখা দিয়েছে এক নতুন সমস্যা। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে তুরস্ক। সুতরাং কী তুরস্কে কিংবা ইরাকে, কুর্দিদের বহুদিনের সম্প্রদায়গত আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে এরদোয়ানের একটি গঠনশীল ভূমিকা থাকা উচিত বলে অনেকে মনে করে।