Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

21k খোলা বাজার২৪, রোববার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬: আজ রোববার পবিত্র হজ। ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুল্কৃ’ অর্থাৎ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, নিয়ামত এবং সব সাম্রাজ্য শুধু তোমারই।’ এই ধ্বনিতে আজ হাজীরা মুখরিত করবেন আরাফাতের ময়দান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, আরবি জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফাতের ময়দানে সকাল-সন্ধ্যা উপস্থিত থাকতে হয়। বাংলাদেশে আজ ৮ জিলহজ, কিন্তু সৌদি আরবে ৯ জিলহজ। তাই এদিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করছেন হাজীরা।
তিনি বলেন, আরবি ‘আরাফাত’ শব্দের অর্থ ‘পরিচিতি’। আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমনের পর দু’জনের অবস্থান ছিল বিপরীত দিকে। দীর্ঘদিন পর পরস্পরের এই আরাফাতের ময়দানে এসে পুনর্মিলন ঘটে। পবিত্র মক্কানগরী থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দান। আরাফাত ময়দানের জাবালে রহমত হচ্ছে পুনর্মিলনের স্মৃতিস্তম্ভ। যেখানে হাজীরা সমবেত হয়ে চুম্বন এবং মোনাজাত করে থাকেন। শুধু তাই নয়, মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি আরাফাত ময়দানের আকাশ-বাতাস ও প্রতিটি বালুকণায় প্রতিধ্বনিত হয় হাজীদের হৃদয়মথিত লাব্বাইক ধ্বনিতে। চারদিকে শুধুই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শানে হাজির হওয়া দু’প্রস্ত সাদা কাপড় পরা লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ। পবিত্র হাদিস শরিফের বর্ণনা মতে, হজের তিনটি ফরজের মধ্যে আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আরাফাতে অবস্থান ছাড়া হজ পরিপূর্ণ হয় না। হাজীরা কেউ তাঁবু টানিয়ে, কেউ কেউ সরকারি হজ ক্যাম্পে, আবার অধিকাংশই খোলা আকাশের নিচে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এক কাতারে মিলিত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাবেন।
মূলত হজ বলতেই বোঝায় আরাফাতের ময়দানে অবস্থান। এখান থেকেই শুরু হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা। আরাফাতের মসজিদে নামিরাহ থেকে দেয়া হজের খুতবা শোনা, আরাফাতের ময়দানে বসে নিজের পাপমোচন, পরিবার, দেশ, মুসলিম উম্মাহ ও সারা পৃথিবীর মানুষের শান্তির জন্য দোয়া করাই প্রধান কাজ। সাধারণত সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা পাঠ করেন। যেহেতু হজের অন্যতম অনুষ্ঠান আরাফাতের ময়দানে সকাল-সন্ধ্যা অবস্থান করাকে বোঝায়, তাই হজ ভিসা নিয়ে যারা সৌদি আরবে গিয়ে অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে এদিন আরাফাতের ময়দানে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নেয়া হয়।
পবিত্র হাদিস শরিফের বর্ণনা মতে, হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় ৮ জিলহজ। হাজীরা ৭ জিলহজ রাতেই তাঁবুর শহর মিনায় চলে যান ও রাতে অবস্থান করেন। মিনায় ৮ জিলহজ সূর্যোদয় থেকে ৯ জিলহজ সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করা হজের অন্যতম অংশ। সৌদি আরবের ৯ জিলহজের তারিখটি আজ। ফজর নামাজ শেষে কেউ হেঁটে, আবার কেউ বিভিন্ন যানবাহনে করে হাজির হন ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে। লাখ লাখ মুসল্লি উচ্চকিত কণ্ঠে তালবিয়া (লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইকৃ) পাঠ করে মহান স ষ্টার কাছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আশরাফুল মাকলুকাতের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। নিজেকে সমর্পণ করছেন তাঁরই খেদমতে। এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবেন হাজীরা। কেউ পাহাড়ের কাছে, কেউ খোলা ময়দানে, আবার কেউ সুবিধাজনক জায়গায় বসে ইবাদত করবেন। আজ আরাফাতের ময়দানে খুতবার পর জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করে হাজীরা সূর্যাস্তের পর যাবেন মুজদালিফায়। আরাফাত ময়দান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে চারদিকে পাহাড় ঘেরা বিস্তীর্ণ ময়দান এই মুজদালিফা। এখানে মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করবেন সবাই। এই মুজদালেফার খোলা আকাশের নিচে ধনী-দরিদ্র, ফকির-বাদশা সবাই একই ময়দানে রাতে অবস্থান করবেন। এখান থেকেই মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় নুড়ি পাথর (ক্ষুদ্রাকৃতির পাথর) সংগ্রহ করবেন হাজীরা।
সহীহ হাদিসের বাণী হচ্ছে- আরাফাতের ময়দানে হাজীরা যে দোয়া করেন আল্লাহ তা কবুল করেন। এখানে পাপমোচনের পাশাপাশি ইহ ও পরকালের জন্য দোয়া করবেন তারা। এ দিন হাজীরা ছাড়া বাকি মুসলমানরা রোজা রাখলে দু’বছরের সমান সওয়াবের অধিকারী হন। একই গোলার্ধে অবস্থানের পরও যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের একদিনের তফাত আছে। তাই সৌদি আরবে হজের দিন বা বাংলাদেশে ৮ জিলহজ এবং পরদিন ৯ জিলহজ এই রোজা রাখা উত্তম বলে মনে করেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেমরা।
১০ জিলহজ মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায়ের পর হাজীরা মিনায় নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের পরদিন (১০ জিলহজ) মিনায় হাজীরা বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারবেন, পশু কোরবানি করবেন। এরপর মক্কায় পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ, জমজম কূপের পানি পান ও সাফা- মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সা’ঈ করবেন। এই তাওয়াফের নাম বিদায়ী তাওয়াফ। এরপরই হাজীরা মাথা মুণ্ডন করেন। এর আগে সৌদি আরব গিয়েই হজযাত্রীরা প্রথমেই ওমরাহ পালনের জন্য একবার অবশ্যই পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ ও সা’ঈ করেন। বিদায়ী তাওয়াফ সেরে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ সেখানে অবস্থান করে প্রতিদিন তিন শয়তানকে পাথর মারবেন। এভাবে সম্পন্ন হবে হজের গোটা আনুষ্ঠানিকতা। এরপরই ইহরামের দু’প্রস্ত সাদা কাপড় ছেড়ে স্বাভাবিক কাপড় পরিধান করবেন হাজীরা।
‘হজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ইচ্ছা করা’। ইসলাম ধর্মের পাঁচ স্তম্ভের একটি হচ্ছে হজ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫০টির বেশি দেশ থেকে এবার প্রায় ৩০ লাখ মুসল্লি হজ পালন করছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন এক লাখেরও বেশি।
সৌদি সরকারের বিশেষ ব্যবস্থায় এবারও উন্মুক্ত ময়দানের সব তাঁবু কেবলামুখী করে বাঁধা হয়েছে। আরাফাত ময়দানে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স, হেলিকপ্টারসহ ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সার্বক্ষণিক টহল দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এবারও মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় ছোট ছোট অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালে সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গরমের প্রকোপ বেশি থাকায় বিশাল ময়দানজুড়ে শত শত শীতল পানির ফোয়ারার মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে তাপমাত্রা ঠাণ্ডা রাখা হচ্ছে। এ দিন হাজীদের পিপাসা মেটাতে ১৫ লাখ গ্যালন জমজমের পানি মজুদ রাখা হয়েছে। নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরির জন্য মক্কা, মদিনা, মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় এবার মোতায়েন করা হয়েছে এক লাখেরও বেশি সেনা ও পুলিশ সদস্য। নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করায় বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশ থেকে আগত ৩০ লাখেরও বেশি হাজী এবার নিশ্চিন্ত মনেই হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে পারছেন।
এবারের হজে নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তার স্বার্থে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে। হাজীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিশাল স্বেচ্ছাসেবক, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিযুক্ত রয়েছে। বৈধ হাজীদের নিরাপদে হজ পালনে অবৈধ হাজীদের আটকে পবিত্র নগরীর চেক পয়েন্টগুলো নিয়োজিত রয়েছে ১ হাজার ২০০ পুলিশ। হাজীদের সঠিক পথনির্দেশনার জন্য সাড়ে ৪ হাজারের বিশাল (স্কাউট) স্বেচ্ছাসেবক দলও হাজীদের সেবায় নিয়োজিত থাকছে। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যদি ঘটে; সেক্ষেত্রে হাজীদের যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ১৭ হাজারের বিশাল কর্মী বাহিনী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ৩ হাজার উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতিও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।