প্রায় একশ বছর আগের কথা। সাত কল্যান্দীর ঐতিহ্যবাহী পঞ্চায়েতে বসবাসকারী মানুষ ছিলেন খোলা মনের। বর্তমানেও এই বৈশিষ্ঠ্য থেকে দুরে সরে যায়নি এই এলাকার মানুষ। একশ বছর পূর্বে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে আড়াইহাজার উপজেলার সাত কল্যান্দীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন সম্মিলিত প্রচেস্টায় নির্মাণ করেন একটি সুরম্য মসজিদ। মসজিদের নাম কল্যান্দী শেখবাড়ী বাইতুন নুর জামে মসজিদ। তৎকালীন রীতি রেওয়াজ মেনে মসজিদটি তৈরী করা হয়েছিল মোগল আমলে প্রচলিত ডিজাইন অনুসরন করে। কালের বিবর্তনে এবং যুগের চাহিদায় এই মসজিদটি আজ অনেকাংশে চলে গেছে লোক চক্ষুর অন্তরালে প্রায় ধ্বংসের পথে। কিন্তু এলাকাবাসী ব্রিটিশ আমলের এই মসজিদটি নিয়ে গর্ববোধ করে। স্থানীয় মসজিদটির নিজস্ব জমিতে নতুন করে বর্ধিত আকারে নির্মাণের জন্য সম্প্রতি দ্বিতল ভবনের কাজ শুরু করে, তবে অর্থের অভাবে বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে কাজ। এদিকে সংস্কারের ধিরগতীর কারণে ধংব্বসের পথে মসজিদটি। গ্রামবাসী ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটির উন্নয়নে জন্য সমাজের বিত্তবান মানুষের সহায়তা কামনা করেছেন।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য : তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির নকশা রীতি মোগল আমলের। একতলা হলেও উচ্চতায় দোতলার কাছাকাছি। দুপাশে রয়েছে দুটি করে বড় জানালা। একটি মেহরাব। ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে মসজিদটির সৌন্দর্য্য। শত বছর পার হলেও এখনো স্বমহিমায় দাড়িয়ে আছে এই অনন্য স্থাপনাটি। যুগের চাহিদায় মসজিদে সংযোজিত হয়েছে মাইক। এক সময় মাইক ছাড়াই মুয়াজ্জিানের আযান শুনে নামাজ আদায় করতে আসতেন সাত গ্রামের মানুষ। ব্রিটিশ আমলে এখনকার মত গ্রামে গ্রামে মসজিদ ছিলনা। তাই মনের টানে মানুষ মহান আল্লাহ পাকের দিদার পেতে ছুটে যেতেন দুরের গ্রামের মসজিদে। তেমন একটি দুরের মসজিদ হল কল্যান্দী শেখবাড়ী বাইতুন নুর জামে মসজিদ। পুরো সাতকল্যান্দী ও আশপাশ গ্রামের চলাচল ছিল তখন নৌপথে। কল্যান্দী শেখবাড়ী খালটি ছিল তখন এ অঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান পথ। বাইল্যাপাড়া কল্যান্দী শেখবাড়ী খাল দিয়ে বড় বড় গয়না নৌকা চলাচল করতো। মসজিদটি ছিল ঠিক খালের পাড়ে। বহু দুর থেকে অনায়াসে চোখে পড়তো মসজিদের উঁচু গম্বুজ। খাল দিয়ে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে বড় বড় গয়না নৌকা নিয়ে ব্যাপারিরা মোকামে যাওয়ার সময় নামাজের সময় হলে এই ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে নামাজ আদায় করতো। এ কারনে শেখবাড়ী মসজিদের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল দুরদুরান্তে। একনামে সবাই মসজিদটিকে চিনতো।
কালের সাক্ষী নবিউল্লাহ শেখ : মোগল আমলের ডিজাইনে তৈরী ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ নির্মাণের সঠিক দিন তারিখ কেউ জানেনা। সবাই জানে দ্বিতীয় সংস্কারের কথা। শেখ বাড়ীর অশীতিপর বৃদ্ধ নবিউল্লাহ শেখ স্মৃতির পাতা হাতড়ে দ্বিতীয় সংস্কারের তারিখ হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলা ১৩৩০ সনের কথা। বাংলা ১৩৩০ সালের পবিত্র রমজান মাসে মসজিদটি দ্বিতীয়বারের মত সংস্কার কাজ শুরু হয়। নবিউল্লাহ শেখ এর শৈশব কৈশোর কেটেছে মসজিদকে ঘিরে। বাড়ীর কাছে হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তিনি মসজিদের আশেপাশে খেলাধুরা করে বড় হয়েছেন। এই মসজিদেই হুজুরের কাছে আরবী তালিম নিয়ে শিখেছেন কলমা ও নামাজের কায়দা কানুন ।
নবিউল্লাহ শেখ স্মৃতিচারণ করে বলেন , শেখবাড়ী খালপাড়েই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। এর উদ্যেক্তা ছিলেন সলিম শেখ প্রধান , কলিম শেখ , হাবিবউল্লাহ শেখ , নবিউল্লাহ শেখ , আবু শেখ , বসিরউদ্দিন মিয়া ও শুক্কুর আলী । কল্যান্দী শেখবাড়ী খালটি এক সময় ছিল ব্রক্ষপুত্র নদের শাখা খাল। এই খাল বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। অত্র অঞ্চলের মানুষের মূলপেশা ছিল কৃষি। বড় বড় নৌকা নিয়ে এই এলাকার সাধারন মানুষ ধান কাটতে চলে যেত বিভিন্ন জেলায় তখন বলা হতো উত্তর বা দক্ষিনে যাবো। অনেকে আবার নদীতে মাছ ধরার কাজ করতো। ফলে কল্যান্দী শেখবাড়ী খালটির গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। সম্ভবত এ কারনে সাত কল্যান্দীর একমাত্র মসজিদটি নির্মিত হয়েছে খাল পাড়ে। এখন সাতকল্যান্দীতে ১২/ ১৫ শতাংশ জমির উপর নির্মিত এ মসজিদটি। তখন একমাত্র মসজিদ হওয়ায় সবার আবেগ অনুভূতি ছিল এই মসজিদকে ঘিরে। মসজিদের তৎকারীন দ্বিতীয় দফায় ঈমাম ছিলেন মাওঃ বোরহানউদ্দিন সাহেব। তিনি ছিলেন পাঁচগাঁও কামরাঙ্গির চরের বাসিন্দা। মাওঃ বোরহানউদ্দিন সাহেবের নানা ছিলেন এই মসজিদের প্রথম ঈমাম। তাঁর বাড়ী ছিল পাঁচগাঁও খন্দকার বাড়ী। এখন শুধু বালিয়াপাড়া কল্যান্দীর মানুষ নামাজ পড়ে। কালের বির্বতনে শুকিয়ে গেছে বালিয়াপাড়া কল্যান্দী খাল। সাতকল্যান্দীর মানুষের চলাচলের পথ ও পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো খালের উপড় এখন ইট-সুরকির রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করে। খালের চিন্থও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বেড়েছে বসতি। ঘন ঘন টিনের ঘর ও ইটের দেয়ালের কারনে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি। অনেকে এখন মসজিদটিকে শেখবাড়ীর মসজিদ মনে করেন। কিন্তু শেখবাড়ীর লোকজন তেমনটা ভাবেননা। শেখবাড়ীর মুরুব্বীরা এই মসজিদকে সাতকল্যান্দীর মসজিদ হিসেবেই ভাবেন। শেখবাড়ীর মানুষরা বলেন , এটা পুরো সাতকল্যান্দীর ঐতিহ্য। এটা আমাদের একার সম্পদ নয়। তাই সবার উচিৎ এই মসজিদের উন্নয়নে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করা। তবেই ঐতিহ্য রক্ষা পাবে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের কথা।