Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

images

খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬:   ফিশারিতে মাছ চাষ করে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে কিশোরগঞ্জের খায়রুল ইসলাম। জেলার বাইরে কয়েক শ’ টন মাছ বিক্রি করে বিরাট অঙ্কের অর্থ আয় ছাড়াও তার ঝুলিতে উঠেছে সরকারী পদক। শুধু খায়রুল নন, মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন দেশের লক্ষাধিক মানুষ। আর মাছ চাষের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। বর্তমানে স্থানীয় বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ক্রমাগত ফিশারির সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও স্বাধীনতা পরবর্তী ফিশারিজ থেকে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১.৬ গুণ। দেশে প্রতিনিয়তই মাছ চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছের চাষাবাদে পিছিয়ে আছে দেশ। এক্ষেত্রে গুণগতমানের হ্যাচারির অপর্যাপ্ততা ও চাষের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করাকে দায়ী করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ এ্যান্ড এ্যাকোয়াকালচার-২০১৬’ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ফিশারিজ পদ্ধতিতে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষ কোন না কোনভাবে মৎস্য চাষ ও মৎস্য সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরমধ্যে প্রায় ১৪ লাখ নারী মৎস্য খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, বিগত ৭ বছরে মৎস্য খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অতিরিক্ত প্রায় ৬ লক্ষাধিক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬১ হেক্টর। উন্মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ৩৯ লাখ ৬ হাজার ৪৩৪ হেক্টর। জানা গেছে, দেশে মোট হ্যাচারির সংখ্যা ৯৪৬। এর মধ্যে সরকারী মৎস্যবীজ উৎপাদন খামারের সংখ্যা ১৩৬। আর বেসরকারী মৎস্য হ্যাচারির সংখ্যা ৮৬৮। মোট ফিশারির সংখ্যা জানা না গেলেও মৎস্য অধিদফতর ও মৎস্য বিশেষজ্ঞদের দাবি দেশে দিনদিন বাড়ছে ফিশারির সংখ্যা।

মৎস্য অধিদফতরের ২০১৪-১৫ সালের তথ্যমতে, দেশে মৎস্য চাষীর সংখ্যা ১ কোটি ৪৬ লাখ ৯৭ হাজার। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকেও অনেকেই এগিয়ে এসেছেন মাছ চাষে। তালিকায় যেমন রয়েছেন সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তেমনি পল্লী চিকিৎসক। চাষীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মাছের উৎপাদন। ২০০৮-০৯ সালে ২৭ দশমিক শূন্য ১ লাখ মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন হলেও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক ৮৪ লাখ মেট্রিক টনে। আর সরকারের টার্গেট ২০২১ সালের মধ্যে তা ৪৫ দশমিক ৫২ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীতকরণের।

মাছ চাষের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন ওয়াহিদা হক বলেন, ‘বাজারে যেসব মাছ পাওয়া যায় তার অধিকাংশই চাষের মাছ। নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশে মাছ চাষের সম্প্রসারণ ঘটেছে। মাছ চাষের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনেকটা সম্প্রসারিত হলেও সব সময় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না।’ আর মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক রিপন বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশে মাছ উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ফিশারিজে মাছের উৎপাদন কমেছে, বেড়েছে এ্যাকোয়াকালচারে। সাদা মাছ চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

মাছ চাষের বর্তমান চিত্র ॥ সরেজমিনে দেখা গেছে, ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ফিশারিতে মাছ চাষ। সম্প্রতি গফরগাঁও থেকে ভালুকা আসার পথে রাস্তার দুপাশে যেদিকে চোখ যায় শুধুই বিশালকায় বড় বড় মাছের খামার। কোন কোন খামার ঠিক যেন বিলের মতো। কোনটি আবার ছোট্ট হাওড়! সেসব খামারে নৌকায় চড়ে খামারিদের খাবার দেয়ার দৃশ্যও ছিল মনোমুগ্ধকর। পানিতে ভাসা নৌকা যখন খাবার দেয়ার নির্দিষ্ট স্থানে এগিয়ে আসছিল তখন একসঙ্গে লাফ দিয়ে উঠছিল অজস্র মাছ। জানা গেছে, উপজেলার ত্রিশালেও ব্যাপকমাত্রায় সম্প্রসারণ ঘটেছে ফিশারির। তবে পিছিয়ে আছে সড়ক যোগাযোগ থেকে ‘প্রায় বিচ্ছিন্ন’ উপজেলা গফরগাঁও! অঞ্চলটিতে বাড়েনি ফিশারির সংখ্যা। জানা গেছে, কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও ফিশারিতে মাছ চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজস্ব উদ্যোগে এগিয়ে আসছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে অঞ্চলটিতে কাজ করে যাচ্ছে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।

সূত্রমতে, হাওড় ও পাহাড়ের জেলা হবিগঞ্জেও মাছ চাষের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। শিকারিদের হাত থেকে প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ রক্ষার্থে মাছের অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে কাজ করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। জনসাধারণকে দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ। একইভাবে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে বরিশালের অজস্র পরিবার। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও দিন দিন স্বাবলম্বী হওয়া পরিবারের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ওই জেলার আগৈলঝাড়ায় ডিম থেকে পোনা মাছ উৎপাদন ও বিক্রি করেই সাবলম্বী হয়েছে অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার। একইভাবে ঝিনাইদহে মাছ চাষ করে সাবলম্বী হয়েছে ৪৩ নারী। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বলকান্দার গ্রামে শিরীষকাঠ খালে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে তারা হয়েছেন সফল।

জানা গেছে, মাছ চাষে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মাছ চাষীরাও। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে বেকারত্ব মোচনের পাশাপাশি অধিক লাভবান হচ্ছেন তারা। দেলদুয়ার আটিয়া ইউনিয়নের আটিয়া গ্রামে পাঙ্গাশের চাষ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। গ্রামের চারপাশে ছোট-বড় প্রায় দুই শতাধিক পুকুর। চাষীও প্রায় দেড় শতাধিক। অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী। সর্বোপরি এভাবেই সারাদেশে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ।

সফল মাছ চাষী যারা ॥ মাছ চাষ ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে অনন্য অবদানের জন্য ২০১৬ সালে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার পেয়েছেন ২০ জন। এরমধ্যে স্বর্ণপদক পেয়েছেন ৫ জন, আর রৌপ্যপদক পেয়েছেন ১৫ জন। রৌপ্যপদকপ্রাপ্তদের একজন কিশোরগঞ্জের খায়রুল ইসলাম। সদর উপজেলার ভাটগাঁও গ্রামে তিনি ২০ বছর ধরে মাছ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন ‘মাছ খায়রুল’ নামে।

গুণী এই মাছ চাষীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে মাছ চাষে সম্পৃক্ত হন তিনি। তখন সে নবম শ্রেণীর ছাত্র। শুরুটা মাত্র সাড়ে সাত একর জমিতে হলেও বর্তমানে ৫২ একর জমিতে ১৩ টি পুকুরে সম্প্রসারিত হয়েছে তার ফিশারি। এসব ফিশারিতে দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ করছেন। পাবদা, গুলশা, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া, কৈ চাষেই মনোযোগ তার। তার ফিশারি থেকে প্রতিবছর ১৮০ থেকে ২৫০ টন মাছ কিশোরগঞ্জ সদরসহ ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে তার অধীনে কর্মরত ৪৫ কর্মী। অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকার শিক্ষিত ও বেকার যুবকরাও শুরু করেছেন ফিশারির তত্ত্বাবধান।

খায়রুল বলেন, আমাকে মূল্যায়নের জন্য সরকারের কাছে আমি অন্তরিক কৃতজ্ঞ। পারিবারিক দুরবস্থা থেকে মাছ চাষে এগিয়ে আসি। বহু প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও থেমে থাকিনি। এই অঞ্চলের বহু মানুষ আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শত শত ফিশারি গড়ে তুলেছে। ফিশারির মাধ্যমে এলাকার বেকারত্ব দূর হয়েছে। এখন অনেক শিক্ষিত মানুষও তার নিজস্ব জলাভূমিতে মাছ চাষ করছেন। যারা মাছ চাষে নতুন তাদের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকি।

বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থেকেও মাছ চাষ ॥ ঢাকায় পুলিশ সার্জেন্ট পদে কর্মরত এনামুল হাসান সৌরভ। এই পুলিশ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ৮০ শতাংশ জমিতে বছরখানেক যাবত বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ হচ্ছে। তিনি বলেন, সপ্তাহে একদিন খাবার দিতে হয়। দেখাশোনায় বাড়তি কোন ঝামেলা নেই। বছরের শুরুতে ৩০ হাজার টাকার মাছ দিয়েছি। বছর শেষে সেই মাছ ১ লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার তত্ত্বাবধানে বাবার দেখাশোনায় মাছ চাষে ব্যাপক সফলতা এসেছে।

কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার জিরু আইশ গ্রামের বাসিন্দা আলী আকবর। পেশায় পল্লী চিকিৎসক। ২ বছর ধরে নিজের ৮ শতাংশ জমিতে চিংড়ি চাষ করছেন। তিনি বলেন, পূর্বে অনেকের ধারণা ছিল মিষ্টি পানিতে চিংড়ি চাষ সম্ভব নয়। মিশ্র চাষে চিংড়ির জন্য আলাদা করে খাবার দিতে হয় না। বছরে ২০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান তিনি। সফলতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আলী আকবর বলেন, আশপাশের অনেক মানুষ আমার সফলতা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে, মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ থাকায় আমিও তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকি।

কুচিয়া চাষ ॥ কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার সুরিখোলা গ্রামে কুচিয়া মোটাতাজাকরণের সঙ্গে যুক্ত নুরুজ্জামান সুমন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে কুচিয়ার চাষ করছি। শুঁটকি জাতীয় খাবার এদের প্রধান খাদ্য। অনেকটা ছোট পুকুর বা ১০ বাই ১৪ ফিট ছোট ছোট গর্তে ২০ কেজি কুচিয়ার চাষ শুরু করি। মাত্র ৫ থেকে ৬ মাসের ব্যবধানে তা ৪০ কেজি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি জানান, একই গর্তে তেলাপিয়া ও ছোট ছোট মাছের চাষ হচ্ছে। তেলাপিয়া মাছ ঘন ঘন বাচ্চা দেয়। গর্তে তেলাপিয়া চাষের কারণ, এদের বাচ্চাগুলো কুচিয়ার অন্যতম পছন্দের খাবার।

পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত অল্টারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এডিআই) কুমিল্লা অঞ্চলের মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আকরামুল ইসলাম বলেন, মাছ চাষের নতুন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে আমরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি। অবলুপ্ত মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করাই আমাদের মূল কাজ। অনেক সময় দেখা যায় টাকা আছে কিন্তু নির্দিষ্ট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না; সেসব মাছের উৎপাদন যাতে বৃদ্ধি পায়, কৃষক যাতে সেসব মাছ ক্রয়ে আগ্রহী হয়, সে লক্ষ্যে নানাভাবে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলছি।

চিংড়ি চাষে সাফল্য॥ চিংড়ি চাষেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। সিলেটের বিশনাথ উপজেলায় বাড়ির পুকুরে অন্যান্য মাছের সঙ্গে গলদা চিংড়ি চাষ করে সফল হয়েছেন মধু মিয়া। অর্জন করে নিয়েছেন সফল চাষী পদক। একইভাবে খুলনায় সফল হয়েছেন সুজিত ম-ল। ১০ বছর ধরে তিনি ঘেরে চিংড়ি চাষ করে আসছেন। বর্তমানে চাষ করছেন আধুনিক পদ্ধতিতে। পূর্বের তুলনায় যেমন তার উৎপাদন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে মুনাফাও। জানা গেছে, সাতক্ষীরা ও পঞ্চগড় এলাকায়ও চিংড়ি চাষে এসেছে ঈর্শ¦ণীয় সাফল্য।

মাছ চাষে প্রতিবন্ধকতা ॥ মাছ চাষে যোগাযোগ ব্যবস্থাই প্রধান হাতিয়ার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পন্ন এলাকায় মাছ চাষের সম্প্রসারণ ঘটে না। এছাড়া গুণগত মানের হ্যাচারির অভাব, মাছের খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। মাছ চাষের প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জের মাছ চাষী খায়রুল বলেন, এলাকায় বড় বাজার নেই। স্বল্প জায়গার কাছারি বাজারে দাঁড়িয়ে মাছ বিক্রি করতে হয়। সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে দ্রুত সময়ে একটি বড় বাজার করে করে দেয়ার। এছাড়া মাছ বিক্রিতে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। আমাদের যে মাছ ৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়, তারা সেই মাছ ১০০ টাকায় বিক্রি করে। এছাড়া মাছের প্রজেক্টে বিদ্যুত সংযোগের স্বল্পতা রয়েছে। আমার একটি প্রজেক্ট বিদ্যুত সংযোগ ছাড়াই চলছে। সরকারের কাছে দাবি, মাছ চাষকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিদ্যুত প্রাপ্তি যেন সহজলভ্য করে দেয়া হয়। প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে অল্টারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভর (এডিআই) কুমিল্লা অঞ্চলের মৎস্য কর্মকর্তা আকরামুল ইসলাম বলেন, দেশে গুণগত মানের হ্যাচারির অভাব রয়েছে। ফলে মাছ চাষীদের পক্ষে অনেক সময় মানসম্পন্ন মাছের পোনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া মাছের খাদ্যের মূল্যের উর্ধগতি, কারেন্ট জালের ব্যবহার ও বিভিন্ন জলাশয় ভরাটের কারণে কোন কোন অঞ্চলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক রিপন বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ কাজে নিয়োজিত জনবল যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক মাছ চাষ এগিয়ে নেয়ার জন্যও জনবল অত্যন্ত কম। মাছের খাদ্য বা খাদ্য উপকরণ পরীক্ষার জন্য মৎস্য অধিদফতরের কোন পরীক্ষাগার নেই। মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে চলছে। কৃষিক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিলেও মাছের খাদ্যে কোন ভর্তুকি দেয়া না। এছাড়া মাছ চাষ বাণিজ্যিক খাত না কৃষির উপখাত তা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। ফলে মাছ চাষীদের ঋণ প্রাপ্তিতেও দেখা দেয় নানা সমস্যা। আর প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন ওয়াহিদা হক বলেন, স্বাভাবিক ভাবে খাল-বিল-নদী-নালায় পানি কমছে। সর্বত্র পানির গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যত চিন্তা করে প্রাকৃতিক জলাশয় রক্ষা করতে হবে। চিংড়ি চাষে দেশ অনেক ভাল করছে। তবে একই সঙ্গে এর প্রভাবে লবণাক্ততাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হ্যাচারির পানি যদি নদীতে ছেড়ে দেয় তাহলে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা বিনষ্ট হবে। সামগ্রিকভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে।

সম্ভাবনা ও ভবিষ্যত ॥ মাছ চাষের মাধ্যমে দেশে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাড়ছে রফতানি আয়। স্বাধীনতা পরবর্তী মৎস্য ও মৎসজাত দ্রব্য রফতানি করে আয় বেড়েছে বহুগুণ। তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ সালে মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য রফতানি হয়েছে ৮৩ হাজার ৫২৫ মেট্রিক টন। আর বছরটিতে রফতানিকৃত দ্রব্যের অর্থমূল্য ছিল ৪৪৬ কোটি টাকা। শুধু রফতানি আয়ই নয়, মাছ চাষের মাধ্যমে দূর হচ্ছে বেকারত্ব। বহু শিক্ষিত যুবক মাছ চাষকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। মৎস্য কর্মকর্তা আকরাম বলেন, দেশে দিন দিন মাছ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। মাছ একদিকে যেমন আমিষের অভাব পূরণ করছে তেমনি মাছ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব দূর হয়েছে। অর্জিত হচ্ছে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা, যা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন ওয়াহিদা হক বলেন, মাছ চাষের সম্ভাবনা অবশ্যই ভাল বলতে হবে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভবিষ্যতে এ খাতে আরও সাফল্য আসবে।

সামগ্রিক প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, মাত্র ৭ বছরে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ লাখ টন, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। ফিশারিজেও বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৬ এর কাছাকাছি। দেশে প্রায় ২৮ লাখ পুকুর আছে, যার মধ্যে মাত্র ১ শতাংশে বাণিজ্যিকভাবে মাছের চাষ হয়। বাকিগুলোতে প্রচলিত বা সনাতন পদ্ধতিতে মাছের চাষ হয়ে আসছে। সর্বোপরি মাছের উৎপাদনে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রসার ঘটছে ফিশারিজের। মৎস্য খাতের প্রতিবন্ধকতা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণে আমরা অত্যন্ত পিছিয়ে আছি। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার মতো ট্রলার নেই।