সম্প্রতি উরিতে সেনা দফতরে হামলায় ১৮ ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, এমনটিই বলছে নয়াদিল্লি।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাস স্বরুপ ও সেনাবাহিনীর ডিজিএমও লে. জে. রণবীর সিংহ। রণবীর বলেন, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখায় সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে সার্জিক্যালে অ্যাটাক করেছে। এতে সন্ত্রাসীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যাদের অনেকেই নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিএনএন সংবাদ চ্যানেলটি জানিয়েছে, কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারতের আক্রমণের ঘটনাটির পর শুত্রুবার পকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ জরুরি কেবিনেট মিটিং ডেকেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দাবি করেছে তাদের মাত্র ২ জন সেনা দু্ই দেশের সীমানায় মারা গেছেন। তারা দুজনের নাম প্রকাশ করেছে। তারা হলেন, নায়েক ইমতিয়াজ এবং হাবিলদার জুম্মা খান।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডিজিএমও রণবীর সিং জানিয়েছেন, এ অভিযান ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। ভারতের নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য এ অভিযান চালানো হয়েছে। আমাদের কাছে তথ্য ছিল সন্ত্রাসীরা অনুপ্রবেশ করে জম্মু কাশ্মিরসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে আক্রমণের পরিকল্পপনা করছে।
একজন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা সিএনএন’কে জানিয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জম্মু অঞ্চলের সীমান্তবর্তী কিছু গ্রাম থেকে আগেই মানুষজনদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
সিএনএন জানিয়েছে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আমাদের সেনাবাহিনী সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ করেছে। ভারত যদি আবারো এরকম কাজ করে তাহলে আমরা সর্বাত্মক আক্রমণে যাব। ভারত তার পাবলিক ও মিডিয়াকে খুশি করার জন্য এ ধরনের কাজ করছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভারতের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখায় যে সার্জিক্যাল অ্যাটাকের কথা জানিয়েছে তা ভিত্তিহীন। ভারত মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাছাড়া এসব উত্তেজনার জন্য ভারতই দায়ী বলে উল্লেখ করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব ইসলামাবাদে ভারতের হাইকমিশনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই আক্রমণ যে ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থী তা স্মরণ করে দিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ভারতের সেনা অভিযানের জবাব দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন দেশটির সাবেক ক্রিকেটার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফ’এর প্রধান ইমরান খান। শুক্রবার রাওয়ানদিতে অনুষ্ঠিতব্য দলের সমাবেশে তিনি কীভাবে প্রতিবাদ জানাতে হয় তা নওয়াজকে দেখিয়ে দেবেন বলেও জানিয়েছেন।
পাক-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনে জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ মুখপাত্র স্টিফেন দোজারিক দুই দেশকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সংযম দেখাতে আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে সংকটের সমাধান করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত করেছেন।
এদিকে বিবিসি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেছেন, কোনো কিছুই কিন্তু নিশ্চিত নয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দাবি করছে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গোলাগুলি হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন্স কিছু দাবি করেছেন, কিন্তু সেখানকার সাংবাদিকরা এসবের কিছুই নিশ্চিত করতে পারেননি। সুতরাং আমরা শুধু দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যই জানতে পারছি। কিন্তু যেটা আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারি, তা হলো, উরিতে আক্রমণের একটা সমাপ্তি টানা ভারতের জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন আমাদের দেখতে হবে এটাই সেই সমাপ্তি কিনা। এখন আমরা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের জন্য অপেক্ষা করব কিনা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ২ সৈন্য নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে ডনের এক খবরে বলা হয়, ওই দুই সৈন্য কিভাবে নিহত হয়েছে তা তারা নিশ্চিত নয়। এছাড়া নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সার্জিক্যাল অ্যাটাকের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। দেশটির সেনাবাহিনী বলছে বিনা উস্কানিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখায় হামলা করেছে। এর উপযুক্ত জবাব দিয়েছে তারা।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডিজিএমও রণবীর সিং সাংবাদিক সম্মেলনে এ অভিযানকে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলে দাবি করেছেন। কোনো পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানাকে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলে।
ভারতের আনন্দবাজারে পত্রিকা জানিয়েছে, বুধবার গভীর রাতে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে আচমকা অভিযান চালিয়ে একাধিক জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করে ভারতীয় সেনারা নিজেদের ব্যারাকে ফিরে এসেছে। শুধু এটুকু নয়, এই প্রথম নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে সেনা অভিযানের কথা বুক ঠুকে ঘোষণাও করে দিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। পাকিস্তানকেও সরকারিভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো সে কথা। সেনাবাহিনীর দাবি, নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় থাকা জঙ্গিদের একাধিক ঘাঁটিতে বুধবার গভীর রাতে অভিযান চালানো হয়। রাত সাড়ে ১২টা থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে একাধিক জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করে ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে আসেন সেনা কম্যান্ডোরা। সেনার স্পেশ্যাল ফোর্সের প্যারা কম্যান্ডোদের এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এ অন্তত ৩৮ জন জঙ্গি এবং দুই পাক সেনা জওয়ান নিহত হয়েছে। ভারতীয় জওয়ানদের কেউ হতাহত হননি বলেই সেনার দাবি।
পাকিস্তানের পত্রিকা দৈনিক ডনের খবরে দাবি করা হয়েছে, কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারতের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে পাক সেনাবাহিনীর পাল্টা হামলায় ভারতের আট সৈন্য নিহত হয়েছে। অপর এক ভারতীয় সৈন্যকে আটক করেছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর ভারতের ১৪ সৈন্য নিহত হয়েছে বলে দাবি করেন। বৃহস্পতিবার নিয়ন্ত্রণ রেখার টাত্তা পানিতে এ প্রাণহানির ঘটনা ঘঠেছে।
পাকিস্তানের জিও নিউজ চ্যানেলটির প্রধান হামিদ মীর বলেছেন, দুই সেক্টরে ১৪ ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছেন। জিও নিউজে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ইজাজ আওয়াজ এমনটাই দাবি করেন।
এদিকে আটক ভারতীয় সেনার বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। তার নাম চান্দু বাবুলাল চোহান। তাকে একটি গোপন জায়গায় স্থানান্তর করা হয়েছে। তার বাবার নাম বাশান চোহান। বয়স ২২ বছর। ধর্ম হিন্দু। তার বাড়ি ভারতের মহারাষ্ট্রে।
নিয়ন্ত্রণ রেখার যে এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছে সেখানে এখনও ভারতীয় সৈন্যদের লাশ পড়ে আছে। ভারতের সেনাবাহিনী তাদের লাশ উদ্ধারে এখন পর্যন্ত কোনো চেষ্টা চালায়নি।
জিও নিউজের সূত্র দাবি করেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে গুলি ছোঁড়ায় ঘটনাস্থলে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত তাদের লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করেনি।