খোলা বাজার২৪, শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৬ : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে ব্যাপক ভিত্তিক অর্থনৈতিক অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অপরাধ বন্ধে বিশেষ করে ব্যাংক ডাকাতি বন্ধে জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদের প্রতি জোড়ালো আহ্বান জানান।
তারা এ মর্মে রাষ্ট্রপতির আরো আহ্বান জানান যে, অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্তে বিশেষ করে প্রতি বছরে বাংলাদেশ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার অর্থপাচারের বিষয়টি তদন্ত করতে একটি নিরপেক্ষ , বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহনযোগ্য তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
শুক্রবার নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি এগেইন্সট ফিনান্সিয়াল ক্রাইমস এগেইনস্ট বাংলাদেশ আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অপরাধ’ বিষয়ক এ আন্তর্জাতিক সেমিনারটির সহযোগিতা করেছে বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার বিষয়ক ওয়াচ-ডগ ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই)’ । সেমিনারে ‘ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইন বাংলাদেশ: মানি লন্ডারিং এন্ড বিওন্ড’ শীর্ষক মুল প্রবন্ধ উপাস্থাপন করবেন, লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, ডঃ শওকত আলী, পিএইডি। সেমিনারে ‘ইলিসিট মানি ট্রান্সফার ফর্ম বাংলাদেশ: পলিসি রিকমেন্ডশন ফর গভার্মেন্ট’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপাস্থাপন করবেন – ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনট্রিগ্রিটি (জিএফআই)-এর চীফ ইকোনোমিস্ট দেব কর, পিএইডি। ‘ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইন বাংলাদেশ: হাউ উইল ইট ইমপ্যাক্ট অ্যাচিভিং সাসটেইনবল ডেভলপমেন্ট গোল’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক (সানি)-এর অর্থনীতির অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান এবং ‘স্যোসিও ইকোনোমিক কন্ডিশন অব বাংলাদেশ’ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বিশিষ্ট লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মাহমুদ রেজা চৌধুরী । লেখক ও সাংবাদিক কাউসার মুমিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ইমরান আনসারী। এছাড়াও সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশেষজ্ঞরা।
ড. শওকত আলী বলেন, সকলের জন্য অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার মৌলিক মানবাধিকারের অংশ। যদি কোথাও কোনো সমাজে সরকারি দুর্নীতি কিংবা পাবলিক প্রাইভেট সেক্টরে দুর্নীতি হয় তাহলে অবশ্যিকভাবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হয়। তিনি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডাটা গবেষনা করে দেখিয়ে বলেন , স্বাধীনতার বিগত ৪৫ বছরে সরকারি পর্যায়ের দুর্নীতির কারণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ১০০ মিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে -তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। তিনি আরো বলেন , বাংলাদেশে প্রধানত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা হচ্ছে শেয়ার বাজারকে কুক্ষিগত করা, রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা ঋণ খেলাপি হওয়া, সংসদ সদস্য , আমলা ও ব্যবসায়িদের দের ঋণ মওকুফ করা ইত্যাদি কারণে।
সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ইন্ট্রিগ্রিটি এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. দেব কর বলেন , অর্থপাচারের জিএফআই সম্প্রতি যে গবেষণা প্রতিবেদন বেরিয়েছে তাতে যে পরিমান অর্থ অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচারের তথ্য দেখানো হয়েছে তার থেকেও বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বলে তিনি মনে করেণ।
বিশ্বব্যাপী অবৈধ অর্থপাচারের সঠিক চিত্র তুলে না ধরতে পারার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন , গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যাপী অবৈধ অর্থ পাচারের যে প্রতিবেদন তুলে ধরে তা পুরো নির্ভরশীল বিভিন্ন দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্য এব সহযোগিতার উপর। কিন্তু এ তথ্য বিনিময় ও সহযোগিতা নিতান্ত সীমাবদ্ধ। দর্শক সারি থেকে আসা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন , যদি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ সরকার অবৈধ অর্থপাচার বন্ধ করতে চায় তাহলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে জিএফ আই এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে। ড, দেব কর আরো বলেন , যদি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা অর্থপাচার বন্ধে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন তাহলে এজন্য তাদেরকে কোনো অর্থও খরচ করতে হবে না। কারণ নরওয়ে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো বহুদেশ রয়েছে যারা এসব কাজে গবেষনা চালাতে নিয়মিত অর্থ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাস্টমস ও ব্যাংকিং প্রশাসন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। ড দেব কর বলেন , বাংলাদেশের জনগনের মধ্য থেকে যদি কোনো গ্রুপ নতুন ধারণা নিয়ে এই অবৈধ অর্থপাচার রোধে গণসচেতনতা বাড়াতে পারে তাহলে এক্ষেত্রে খুবই কাজ হবে । যেমনটা আজকে সেমিনারে উদ্যোক্তারা করেছেন।
মাহমুদ রেজা চৌধুরী বলেন, বর্তমানে আমাদের পুরো জাতি সংকীর্ণ মন মানুষিকতা নিয়ে রাজনৈতি স্বার্থে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আর এই কারণেই আমরা রাজনৈতি ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছি।
অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স মাত্র দেশের ১ শতাংশ লোক লুটপাট করে খাচ্ছে। স্বাধীনতার এই ৪৫ বছরে দেশের জীবন যাত্রার মান উন্নত না হয়ে শিক্ষা ও সাস্থ্য সেবার অবনতিই হচ্ছে। আর রাজনীতিবিদরা তাদের সন্তানদের দেশের টাকায় বিদেশে পড়াচ্ছেন। স্বাগত বক্তব্যে সাংবাদিক ইমরান আনসারী বলেন, স্বাধীন দেশের জনগন এখন স্বদেশি ব্যাংক ডাকাত ও লুটেরাদের যাতাকলে পিষ্ট। প্রতিদিনই গণমাধ্যমের খবর বাংলাদেশের কোনো না কোনো ব্যাংক থেকে অর্থ লুট হচ্ছে। বিভিন্ন নামে এই অর্থ লুটপাট চলছে। লুটপাট চলছে ঋণ খেলাপির নামে, শেয়ার বাজার কেলেংকারি মাধ্যমে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে। একথায় বলা যায় এ যেন ডাকাতি। তিনি আরো বলেন, সবচেয়ে ভংয়কর সংবাদ হচ্ছে এই অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয়া হচ্ছে । জনগনের এই অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য জনগণকেই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে সর্বোপুরি দেশে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে অর্থ লুটপাটকারীদের বিচারের আওতায় আনতে বিশ্বব্যাপী জন আন্দোলন গড়ে তোলবার পরামর্শ আসে সেমিনার থেকে। এক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জনগনের পক্ষে ভূমিকা না রাখবার ব্যর্থতার জন্য বিএনপির কড়া সমালোচনা করেন বক্তারা।