খোলা বাজার২৪,সোমবার,০৩ অক্টোবর, ২০১৬ : বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা করে আরো একটি কলঙ্কিত ৫ জানুয়ারির মতো ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনি প্রহসনের দিকেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। একদলীয় এ সরকারের মেয়াদ প্রায় তিন বছর অতিবাহিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সরকার ও তাদের বানানো বিরোধীদলের সাম্প্রতিক নির্বাচন প্রস্তুতি ও ৫ জানুয়ারির চেয়ে আগামী নির্বাচনে আরো কঠোর হতে একমন্ত্রীর ঘোষণায় ক্ষমতা ধরে রাখতে সরকারের পরিকল্পনাই ফুটে উঠেছে। রাজনীতি ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সবদলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান দেশে-বিদেশে সকলের তাগিদ থাকলেও সরকার আগামী নির্বাচনের বিষয়টি স্পষ্ট করছে না। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন করা না হলে আরেক ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের আয়োজন করলে দেশ আরো সংকটের দিকেই যাবে। এজন্যে এখন থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠনে সকলের মতামত নেয়া উচিত। : অনুসন্ধানে জানা যায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি সংসদের প্রথম অধিবেশন হওয়ার সরকারের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী এর তিন মাস আগে যে কোনো দিন জাতীয় নির্বাচন। সরকারের হাতে এখনো দু বছরের বেশি সময় থাকলেও বাজেট অধিবেশনে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ইতিমধ্যেই ভোটের কলগুঞ্জন শুরু হয়েছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ মোটামুটি হোমওয়ার্ক করে ক্ষমতা ধরে রাখতে ৫ জানুয়ারি স্টাইলে আরো একটি নির্বাচন কোনো মতে আনুষ্ঠানিকতা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে নতুন আজ্ঞাবাহী একটি নির্বাচন কমিশন গঠন, জেলা পরিষদ থেকে উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি পর্যায়ে নিজেদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। একইসাথে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনগুলোতেও দলীয় লোককে নির্বাচন দেখিয়ে বসাচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি এবং তাদের অনুগত ক্যাডারদের দিয়ে মাঠ দখলের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সরকারের এখন টার্গেট জেলা পরিষদ ও মেয়াদোত্তীর্র্ণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। : জানা যায়, আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এরই মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের কাজ শুরু করেছে সরকার। নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের। একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। রাষ্ট্র্রপতি দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি নামমাত্র সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সরকারের অনুগত সাবেক আমলা কাউকে নতুন কমিশনের প্রধান করা হতে পারে। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলবে। : সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবারও ইসি সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়নের কোনো পরিকল্পনা নেই। আগের মতোই সার্চ কমিটি গঠন হতে পারে। তবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন রাষ্ট্রপতি। : এ নিয়ে নির্বাচন বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার দিনকালকে জানান, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য একটি আইন করা প্রযোজন। এই আইনের অধীন স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে সার্চ কমিটি গঠন করে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা উচিত। এরপর সবদলের সাথে আলোচনা করে নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীন সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে হবে। কারণ যতো শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনই গঠন করা হোক, যদি প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনী নিরপেক্ষ না হয় তা হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যাবে না। কিন্তু সরকার এখনো এ বিষয়ে তাদের মনোভাব স্পষ্ট না করায় আরেকটি আজ্ঞাবাহী কমিশন ও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হলে দেশ আরো সংকটের পথেই যাবে। : সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। বিধান অনুযায়ী নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন শুরু হয়েছিল। সেই হিসাবে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে কমিশন। একাদশ সংসদ নির্বাচনও হবে এ নিয়মেই। : ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত ন্যূনতম ৩৮ দিন সময় হাতে রেখে ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন দাখিল ১০-১২ দিন, যাচাই-বাছাই দুই দিন করে চার দিন, প্রত্যাহারের সময় সাত দিন ও প্রচারণার জন্য ১৫ দিন সময় দেয় ইসি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন সাধারণত ৪০-৫০ দিন সময় রেখে তফসিল ঘোষণা করে। সেই হিসাবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষে একাদশ নির্বাচন করতে নভেম্বরের শুরুতে বা মাঝামাঝিতে তফসিল দিতে হবে। ডিসেম্বরের শুরুতে বিভিন্ন স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়। তাই ডিসেম্বরের শেষ দিকে ভোট গ্রহণ হতে পারে। এর আগে দেখা গেছে, সবচেয়ে কম সময় ৪২ দিনে ভোট হয় অষ্টম সংসদ নির্বাচনে। তবে ষষ্ঠ ও নবম সংসদ নির্বাচনে ৪৭ দিন সময় দিলেও সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে তিনবার পুনঃ তফসিল হয়। : সূত্র জানিয়েছে, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই একাদশ সংসদ নির্বাচন চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। তাই ইসি ২০১৮ সালের নভেম্বরের শুরুতে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যে যাদের বয়স ১৮ বছর হবে তাদেরও ভোটার করার জন্য আগাম তথ্য সংগ্রহ করেছে ইসি। এ ক্ষেত্রে ভোটার তালিকার কাজও অনেকটা এগিয়ে থাকছে। : সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে হবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হবে সরকার গঠন। সরকার গঠনের পর ওই সংসদ ও সরকার জাঁকজমকভাবে ২০২১ সালে পালন করবে বাংলাদেশের ৫০তম জন্মদিন। এ জন্য এখন থেকেই নানা ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারের ১৪ দলীয় জোটের সমম্বয়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আগামী নির্বাচন করতে গিয়ে ৫ জানুয়ারির চেয়ে যত কঠোর হতে হয় সরকার তাই করবে। এর আগে গত ২৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তিনি ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারির তিন মাস আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দিকে ইঙ্গিত করে বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড প্রচারের পাশাপাশি জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য দলীয় এমপিদের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও ভেতরে ভেতরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগে।