
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ নয়। তবে যেগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ এবং দুর্নীতি ও লুটপাট বেশি হয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ সেক্টরে অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি এখন সামনে চলে এসেছে। ভুক্তভোগীরা হইচই করছেন। এ খাতে প্রায় আড়াই লাখ ঋণ গ্রহীতা ও আমানতকারী রয়েছেন। এর মধ্যে ঝুঁকিতে আছেন প্রায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার গ্রাহক। বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত না পেলে তাদের পথে বসতে হবে।
এদিকে সূত্র বলছে, তিনটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, যার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান তিনটির মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ৫৮৫ কোটি, পিপলস লিজিংয়ের প্রায় ৪০০ কোটি ও ফার্স্ট ফিন্যান্সের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার এ ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। সংকট উত্তরণে তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক বসিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইডিএলসি ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান বলেন, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম হচ্ছে। এসব অনিয়মের পেছনে সরাসরি পরিচালনা পর্ষদ জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানান তিনি।
বিআইএফসির সাবেক এমডি এনামুর রহমান বলেন, ‘আমি এখন আর ওই প্রতিষ্ঠানে নেই। তাই কোনো মন্তব্য করতে পারব না’।
জানা গেছে, সর্বশেষ পর্যবেক্ষকের আওতায় আসা ফার্স্ট লিজ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১৩ কোটি টাকা মুনাফা করলেও ২০১৪ সালে মুনাফা কমে হয় ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে মুনাফা কমে হয়েছে মাত্র ৯০ লাখ। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ ১৫৮ কোটি টাকা হলেও ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ৩৫৯ কোটি টাকা। এর ফলে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৮ কোটি টাকা লোকসান করে ফার্স্ট ফিন্যান্স। ২০১৪ সালে প্রথম ছয় মাসে সাড়ে ৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন অনুযায়ী ফার্স্ট ফিন্যান্সে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরই মধ্যে উদ্যোক্তাদের চাপে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএ মতিন ২৫ সেপ্টেম্বর হঠাৎ পদত্যাগপত্র জমা দেন। তার চুক্তির মেয়াদ ছিল আরও তিন মাস। এমএ মতিন বলেন, কয়েক দিন আগে পদত্যাগ করেছি। চুক্তির মেয়াদ শেষ না হতেই কেন পদত্যাগ করলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কিছুটা এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে পদত্যাগ করেছি।
বর্তমান এমডি আবুল মুনসুর আহমেদ বলেন, ছোটখাটো ঘটনা সব প্রতিষ্ঠানে থাকে। এর থেকে বেশি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
বিভিন্ন নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ঋণ বিতরণ করেছে ৭৪০ কোটি টাকা। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১৫ কোটি টাকা। একইভাবে ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ৮০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৭০ কোটি টাকা, রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা, উত্তরা ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে ১৭৫ কোটি টাকা খেলাপি ও বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৯০ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইফতেখার আলী খান বলেন, ‘তিনি এখন হাসপাতালে আছেন। কথা বলতে পারবেন না।’ এরপর মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় প্রতিষ্ঠান থেকে বড় ঋণ নিয়ে একের পর এক খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি। ছোট প্রতিষ্ঠানের খেলাপি তো হিসাবের বাইরে। মূলত ব্যাংকের প্রভাব পড়ছে নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও।
সূত্র জানায়, জুন পর্যন্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শিল্প ঋণ রয়েছে ২৪ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দুই হাজার ৭১ কোটি টাকা।
জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের সীমা খুবই সীমিত। তাছাড়া নতুন কোনো ব্যাংক পরিচালনার কার্যক্রমে আসার আগে প্রয়োজন হয় ৪০০ কোটি টাকার মূলধন। অথচ নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে লাগে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। এ সামান্য বিনিয়োগের জায়গা থেকেও টাকা সরিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৩ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৪ সাল শেষে তা বেড়ে হয় ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৫ সাল শেষে তা আরও বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
বিদ্যমান সংকট উত্তরণের বিষয়ে কী ভাবছেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সভাপতি মফিজ উদ্দিন সরকার বলেন, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম হয়েছে। এগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।