Tue. Apr 29th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
কুসংস্কার নয় নবজাতকের প্রয়োজন পুষ্টিসচেতনতা
খোলা বাজার২৪, রবিবার,  ২৩ অক্টোবর, ২০১৬: ‘শাশুড়ি কইছে ভালমন্দ খাওন লাগব না। ভাল খাওন খাইলে ছাওয়াল বড় অইব, পেট ফাড়া লাগব। আমাগো সময় এত্তোগুলান পোলাপান হইছে, আমরা কুনদিন হাসপাতালেও যাইনি। এইডা লজ্জার কতা। পরপুরুষ কত হেইহানে। হাসপাতাল নয়, বাইত্তেই তোমার পেট খালাশ অইব।’  ‘স্বামী ও শ্বশুড়বাড়ির কথা শুনে দশমাস পর মৃত বাচ্চা প্রসব করি। সেই থেকে পেটে ব্যথা ও নানা সমস্যা। শরীর দুর্বল, মাথা ঘোরে সবসময়। ডাক্তার দেখাইলে পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রামের কথা বলে। সবসময় মনমরা হয়ে থাকি। কিছু ভাল লাগে না।’ এমন আক্ষেপ করে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা হোসনেআরা বেগম(২২)।
চট্টগ্রামের রেজিয়া (২৫) ছয় বছর আগে বাড়িতে এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় (যিনি শখ করে সন্তান প্রসব করান) কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকের নজরদারিতে থাকা হয়নি তার। নিজ ও শ্বশুড়বাড়ির আত্মীয়দের নানা বিধিনিষেধের কারণে গর্ভাবস্থায় কখনো ডাক্তারের কাছে যাননি। গর্ভাবস্থায় যে টিকা নিতে হয় তা তিনি জানেন না। পুষ্টিকর খাবারসহ নিজের ও গর্ভের সন্তানের যে বাড়তি যত্ন নিতে হয় সে সম্পর্কেও অবগত নন।
রেজিয়া বলেন, ‘মা বাবা গরীব। স্বামী মুদি দোকানী। অল্প আয়। লেখাপড়াও বেশিদূর করিনাই অভাবের জন্য। মাইয়াডা জন্মের পর থেকে একদিনের জন্যও সুস্থ থাহে নাই। দিনদিন শরীরের ওজন কইমা যাচ্ছে। ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। কইছে শরীরে রক্ত দেওন লাগব। পুষ্টিকর খাবারও। স্বামী বিরক্ত হইয়া জানায় দিছে সে আর আমারে নিব না। বাপের বাড়ি মেয়েসহ আমারে পাঠায়ে দিছে। কোন খোঁজ নেয় না। মরতে ইচ্ছা করে। মাইয়াডার মুখের দিকে চাইবার পারি না।’
শুধু হোসনে আরা বা রেজিয়া নয় তাইয়েবা, শান্তি, লিমার মতো আরও অনেক নারীর অভিজ্ঞতার এমন অজানা চিত্র রয়েছে। লজ্জা, সংকোচ, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অসচেতনতা নারীকে এমন করেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এই পরিস্থিতি শুরু দরিদ্র বা অশিক্ষিত পরিবারগুলোতেই নয়। এমন ভয়াবহ অবস্থা অনেক শিক্ষিত অবস্থাপন্ন পরিবারেও।
গর্ভকালীন সময় থেকে শুরু করে একজন নারীকে কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নিজের ও গর্ভজাত সন্তানের সঠিক পরিচর্যা গুরুত্বপূর্ণ হয়। কিন্তু নানা কুসংস্কার, লজ্জা ও সংকোচের কারণে নারী তার প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে আগ্রহী হন না। পরিবারের মুরব্বী স্থানীয়রা তাদের অভিজ্ঞতা ও খামখেয়ালিপনাকে চাপিয়ে দেন পরিবারের ছেলের বউ কিংবা কন্যা সন্তানটির প্রতি। ফলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক দম্পতি তাদের এই সঙ্কট কালে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা জানান, বাংলাদেশের মেয়েদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি থাকে। তাই গর্ভধারণের পর তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি তাদের পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা এসময় তাদের বিভিন্ন মতামত গর্ভবতী নারীর উপর চাপিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারী অপুষ্টি, রক্তশূন্যতাসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যান। সন্তান প্রসবের পর অনেকে সদ্য প্রসূতিকে শুকনো খাবার খেতে উৎসাহিত করেন। লবণ, ভাত, অল্প সবজি, ভাত, শুকনো তরকারি, কালিজিরা ভর্তা খেতে দেন। তারা মনে করেন শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ খেলে নবজাতকের পেটে ব্যথা ও আমাশয় হবে। আবার তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে প্রসূতির শরীর ফুলে যাবে।
এছাড়া সমাজের সকল স্তরে নারীর লজ্জা ও সংকোচের কারণে গর্ভকালীন পরিচ্ছন্নতা, নিয়মিত চিকিৎসকের নজরদারিত্বে থাকা ও তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ রাখার বিষয় সম্পর্কে সচেতন হন না। গর্ভধারণের পর তার বাড়তি যত্ন, মা ও অনাগত শিশুর পুষ্টির নিশ্চয়তা ও চিকিৎসার সেবা নেয়ার চর্চা বৃদ্ধি পেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বেশিরভাগ অভিভাবক মনে করেন তারা সন্তান জন্ম দিয়েছেন বাড়িতে তাই নিজের মেয়ে বা ছেলের বউকে বাড়িতেই নিরাপদে সন্তান প্রসব করাবেন। জটিল গর্ভধারণ হলে শেষ পর্যায়ে তাকে হাসপাতাল বা কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। ফলে গর্ভবতী নারী ও তার পেটের সন্তান নানা জটিলতায় পড়েন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রতিটি কিশোরী বা তরুণীর অধিকার। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে বেশি চর্চা করলে বিয়ের পর তারা এ ধরনের সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারে। সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে এদেশে স্তন ও জরায়ু নিয়ে নানা কুসংস্কার রয়েছে। একটি কন্যা শিশু এ দুটো বিষয় নিয়ে জড়তার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে।তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি পুষ্টি নিয়েও অবগত করতে হবে।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর বয়সের মধ্যে। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছরের গর্ভবতী কিংবা মা হিসেবে স্বীকৃতি পায় তিন চতুর্থাংশ কন্যা শিশু।
এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্লান বাংলাদেশ এর করা এক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে ১৮ বছর হওয়ার আগে প্রায় ৬৪ শতাংশ কন্যা শিশুর বিয়ে হয়ে যায়। এ সময় পরিবার থেকে তার বিয়ের বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয় না। ফলে তাদের নিজের অজান্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়।
আইসিডিডিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে কম ওজনের শিশু জন্মায় তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।এর প্রধান কারণ মায়ের অপুষ্টি। আয়োডিন স্বল্পতার কারণেও শিশুর সঠিকভাবে মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে না।
শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সুবিধাবঞ্চিত মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা নিশ্চিতে মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। এটি একটি সামাজিক নিরাপত্তামূলক বেষ্টনীর কার্যক্রম। একজন দরিদ্র নারীর তার প্রথম ও দ্বিতীয় গর্ভকালীন সময়ে এ ভাতা পেয়ে থাকেন। গর্ভকাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ২ বছর পর্যন্ত ৩৫০ টাকা করে কয়েক কিস্তিতে এ ভাতা তারা পেয়ে যান। এই অর্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।এই উদ্যোগের কারণে মা ও শিশুমৃত্যু হ্রাস পায়।