খোলা বাজার২৪, সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৬: সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বিভিন্ন কারণে শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই শিক্ষার্থীর নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে আসছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েও যে উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন, তা নিয়ে প্রায়ই লেখালেখি ও আলোচনা চলছে। গত ২০ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র মোতালেব হোসেন লিপু নিহত হয়। পুলিশের দেওয়া প্রাথমিক ভাষ্যমতে, ‘মোতালেব হোসেন লিপুকে খুন করা হয়েছে।’ সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শুধু ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মী নয়, নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীও। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শুধু পড়াশোনা কিংবা পরীক্ষা নয়, নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থাটিও শিক্ষার্থীর নিজেকেই করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাংলাদেশে অনেক। বিশেষ করে আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পরিমাণগত মাত্রাটি একটু বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আজ পর্যন্ত যেসব ছাত্র নিহত হয়েছে, সেগুলোর কোনোটির সুষ্ঠু বিচার হয়েছে বলে জানা নেই। কয়েক বছরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে যেসব শিক্ষার্থী তাদের পরিবার আজও তাকিয়ে আছে কখন হবে তাদের সন্তান হত্যাকারীদের বিচার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত কিংবা ব্যক্তিগত রেষারেষিতে শিক্ষার্থী হত্যার বিচার আদৌ কি কোনো দিন হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে এমন হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ বাড়ায় এখন সবার মনে একটিই প্রশ্ন, এমন ঘটনা কি ঘটতেই থাকবে? কোনোভাবেই কি এসব ঘটনা বন্ধ করা যাবে না? যারা এসব ঘটনায় অভিযুক্ত, কেনই বা তাদের বিচার হয় না? প্রতিনিয়তই কিভাবে তারা বিচারের বাইরে থেকে যায়?
প্রকৃতপক্ষে বিচার হয় না বলেই একের পর এক এমন অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হত্যা ও নির্যাতন নয়, দেশের সর্বত্রই বখাটেদের অত্যাচার বাড়ছে। স্কুল-কলেজের সামনে বখাটেরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করছে। বিশেষ করে মেয়েদের তো কোনো নিরাপত্তাই নেই। সন্তানের নিরাপত্তার ইস্যুতে অভিভাবকরা অনেকেই চুপ করে থাকেন। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন নিরাপত্তার সংকট ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলে রাষ্ট্রের যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ ক্রমেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।
কে বা কারা বিভিন্ন সময় এমন নৃশংস হামলা ও নির্যাতন চালিয়েছে কিংবা চালাচ্ছে, আজ সে বিতর্কে যেতে চাই না। শুধু বলতে চাই, সমাজের তথা জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে ওসব অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে না পারলে চলতেই থাকবে এমন বর্বরতম পৈশাচিক হত্যা, হামলা ও নির্যাতন। এর আগের ঘটনা বিশ্লেষণে খুব স্পষ্ট করে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ঘটে যাওয়া হত্যা, জখম ও নির্যাতনের ঘটনায় বিচারের যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি সহজে এর বিচার হবে কি না তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল আমার প্রিয় ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা রুস্তম নির্মমভাবে তার নিজ কক্ষে নিহত হয়। ঘটনা-পরবর্তী কয়েক দিন সাধারণ ছাত্র ও ছাত্রলীগের আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। জোর দাবি ওঠে ওই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত ও বিচারের। কিন্তু আজও কোনোটিই হয়নি। এ রকম বহু ছাত্র তাদের জীবন বলি দিয়েছে। কিন্তু কোনো বিচার না হওয়ায় অনবরত ঘটেই চলেছে এমন নির্মমতা ও পৈশাচিকতা।
আমার প্রিয় ছাত্র রুস্তম হত্যাকাণ্ডের পর তার লাশ নিয়ে গাইবান্ধার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্য তৈরি হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য প্রতিটি সন্তানহারা পরিবারেই ঘটে। এমন হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিটি পরিবারই সন্তান হত্যার যথাযথ তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে নিজেদের সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই হয় না। বিচারহীনতা কিংবা বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতি সবাইকে হতাশ করে দেয়। এখন সবার মনে একটি প্রশ্ন, এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী? কোনোভাবেই কি এমন সহিংস নেতিবাচক প্রবণতা রোধ করা যাবে না? হয়তো বা এসব ঘটনা প্রতিরোধের যথাযথ উদ্যোগ কর্তৃপক্ষের না থাকার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থী খুন, জখম ও নির্যাতনের মতো ঘটনা অতি মাত্রায় বেড়ে চলেছে। এতে একদিকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, অন্যদিকে শিক্ষার প্রতিটি স্তর আশঙ্কাপূর্ণ হয়ে উঠছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে এসে অনেকেই লাশ হয়ে ঘরে ফিরেছে, আবার অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত শঙ্কিত হচ্ছেন অভিভাবকরাও।
আমাদের দেশে এমন অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়, যেগুলোর অপরাধীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী না দিলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় না। ঠিক তেমনি পুলিশকে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের সামনে সংঘটিত কোনো অপরাধের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কিংবা বাধা প্রদানে এক ধাপও এগিয়ে যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে এমন দর্শকসারির বাহিনীকে সজাগ করে গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করতে না পারলে দেশে এমন নৈরাজ্যকর ও পৈশাচিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। আর ক্রমেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের সবাইকে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিতে কোনো আদর্শ নেই। আছে শুধু আধিপত্যের লড়াই এবং পদ দেওয়া-নেওয়ার একটি প্রতিযোগিতা। সুস্থ চিন্তা, চেতনা ও কার্যক্রমের অভাবে অসুস্থ সন্ত্রাস ভর করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। ফলে নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ।
পরিশেষে এ কথা বলতে চাই, কোনো ছাত্রকে সুপরিকল্পিতভাবে তার নিজ কক্ষে কিংবা নিজ আবাসিক হলের পাশে হত্যা করে ফেলে রাখার মতো জঘন্যতম বর্বরতা আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। আজ যদি কোনো ছাত্র তার নিজ আবাসিকে নিরাপত্তার জায়গাটি খুঁজে না পায়, তাহলে আগামী দিনের যাত্রায় জাতিকে চরম মাসুল দিতে হতে পারে। এখনই সময় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হয়ে বিগত সময়ে ঘটে যাওয়া সব হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।