এ.কে.এম শামছুল হক রেনু ।। খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৩১ অক্টোবর ২০১৬: এদেশে শাসন, প্রশাসন, রাজনীতি ও সমাজের উঁচু জায়গার কোন ব্যাক্তি, গোষ্টি, যদি ডাহা সত্যকে মিথ্যা এবং ডাহা মিথ্যাকে সত্য বলে জাহির করে এবং ডুগডুগি বাজায় তারপরও তালি দেয়ার লোকের অভাব হয়না। আর যদি সমাজের সাধারণ মানুষ সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলে, তারপরও তালি দেয়াতো দুরের কথা, এটাকে কেউ আমলেই নেয়না। এটাই এদেশের চিরাচরিত সংস্কৃতি। এটা থেকে আজো আমরা বেড়িয়ে আসতে পারছিনা বলেই যত দুঃখ, কষ্ট, সমস্যা ও বেদনার আবরণে আচ্ছাদিত।
ছোট বেলার কথা, তখন আমি কোদালিয়া এস.আই. উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। একসময় ঘটা করে স্কুলে নজরুল জন্ম জয়ন্তীর আয়োজন করা হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানটিতে গায়ক, বাদক, কবি ও কিছু গুনীজনকে দাওয়াত দিয়ে আনেন। সেই সময় স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক (Physical teacher) আজহারুল ইসলাম স্যার ও অহীদ স্যারের দিক নির্দেশনা ও গাইড্যান্সে আমন্ত্রিতদেরকে যথাযোগ্য সম্মান ও মোদের বরণীয় সংগীতের মাধ্যমে ফুলের মালা ও পুষ্প বর্ষন করে তাদেরকে বরণ করা হয়। এরই মধ্যে আমন্ত্রিত একজন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা আবৃত্তিতে ছন্দ ও পংক্তিতে বিভ্রাট ঘটালে উক্ত স্কুলের দশম শ্রেণীর জনৈক মেধাবী ছাত্র কবিতার ছন্দ পতন ও পংক্তির ভুল ধরলে, উপস্থিত আমন্ত্রিত মেহমান, শিক্ষক, ছাত্র ও অন্যান্যরা হতবাক ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ নিয়ে মঞ্চে উপবিষ্ট একজন জনৈক ছাত্রকে যথেষ্ট শাসিয়ে নিবৃত্ত করে। যদিও তার প্রতিবাদটা ছিল যৌক্তিক ও বাস্তব। এমনিভাবে স্বাধীনতার আগে পরে এ পর্যন্ত শাসন, প্রশাসন, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে গড্ডালিকা প্রবাহের মতো অনেক কিছুর ভুল, মহাভুল, ধরতে যেমন কেহ সচেষ্ট হয়না, তেমনি এসব কিছুর প্রতিবাদ করতেও অনেক সময় প্রয়োজন মনে করেনা। কারণ এসব কিছুর নেপথ্যে থাকে অসংখ্যা সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী, বসন্তের কোকিল, মৌসুমী পাখী ও সাইবেরীয়ান বার্ডসয়ের মতো সমাজের বিশেষ গোষ্ঠির জি হুজুর মার্কা কিছু চিহ্নিত লোক। যদি কবির ছন্দপতন ও পংক্তির এ ভুল সংশোধন করা হতো, তবে হয়তো এটা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ছন্দপতন ও পংক্তির ভুলের রাজ্যে অনেকেই যেমন সংশোধিত হতো, তেমনি ভুলের দিকে সহজে এগুতনা।
২৭/১০/২০১৬ ইং বৃহষ্পতিবারের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রচ্ছদের লক্ষ্য করলে দেখা যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বাংলাদেশ সচিবালয়ে ২৬/১০/২০১৬ ইং বুধবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে জাতীয় একটি দৈনিকের প্রতিনিধির সাথে একান্ত সাক্ষ্যাকারে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতার রাজনীতির স্রোতধারায় সুবিধাবাদীরা গড়ে ওঠে। মৌসুমী পাখীর মতো (Seasonal birds) এসব অতিথি নেতার দাপটে দলের দুঃসময়ের কর্মিরা হারিয়ে যান। কেউ কেউ কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের মধ্যে মৌসুমী পাখীদের ঠাঁই হবেনা। দলের নবাগত সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর এ উচ্ছাসের পর মূলত দলের মৌসুমী পাখীই নয়, সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী, বসন্তের কোকিল ও শীতকালীন সাইবেরীয়ান বার্ডসদের সম্পর্কে বুঝতে আর কারো কিছু অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। তাছাড়া ২৭/১০/২০১৬ ইং অন্য একটি অনুষ্ঠানেও তিনি মৌসুমী পাখীর মতো দলের বসন্তকালের কোকিলদের সম্পর্কে তীর্যক মন্তব্য ও সমালোচনা করেন। বিলম্বে হলেও দেশের মানুষের কাছে নবাগত সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রীর এ অভিব্যক্তি ও উচ্ছাস পংখিলতার বিরুদ্ধে আশার বাণী ও নবদিগন্তের উম্মেষও বটে। এটা শুধু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকেই নয়, শাসন, প্রশাসনসহ সমাজের সর্বত্র, এমনকি রক্তের শিরায় শিরায়, ধমনী ও নাড়িভূঁড়িতে এসব মিশে গিয়ে সবকিছুকে তিলে তিলে ক্ষত বিক্ষত ও বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। যে কারণে দেশের শ্রেণী পেশার মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিপর্যস্ত ও স্বচ্ছ রাজনীতিকরা আজ হতবাক। সামনে মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে ২৮/১২/২০১৬ ইং জেলা পরিষদের নির্বাচন আসছে। সেখানে কি হয়, না হয় আল্লাহ জানেন। এ নির্বাচনেও যদি কোনক্রমে মৌসুমী পাখী, বসন্তের কোকিল ও সাইবেরীয়ান বার্ডসদের আগমন ঘটে তবে হয়তো দুঃখ, বেদনা বলার জায়গাও থাকবেনা। কারণ মৌসুমী পাখীদের কোন দল নেই, দর্শন নেই, আদর্শ নেই। এদের মূল দর্শন হচ্ছে যা পাওয়া লুঠেপুটে খাওয়া। বাকির খাতায় শুন্য। তাই হয়তোবা দার্শনিক সক্রেটিস বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে ভক্তদের বলেছিলেন, I to die, you to live, Which is better only good knows. অর্থাৎ আমি মরতে যাচ্ছি, তোমরা বেঁচে থাকবে, কোনটা ভালো একমাত্র আল্লাহই জানেন।
এ নিবন্ধের ধারাবাহিকতায় আলাপ প্রসঙ্গে সরকারী অফিসে কর্মরত একজন অবসর প্রাপ্ত উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট থেকে জানা যায়, ৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর প্রধান লেঃ জেঃ এইচ.এম এরশাদ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সি.এম.এল.এ) হিসেবে ক্ষমতায় আসার আগমুহুর্ত পর্যন্ত তার দেখা ও জানামতে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, বিএনপি ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের এত ভক্ত, অনুরুক্ত ছিল, যা কল্পনা করা যায়না। তাদের অফিসে এবং বাসভবনের টেবিলের ডেস্ক ক্যালেন্ডারের পাশে যেমনিভাবে সোনালী ফ্রেমে বাঁধাই করে জিয়াউর রহমানের ফটো সাজিয়ে রাখা হতো তেমনি বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষকে সোনার ধানের শীষ বানিয়ে টেবিলে রাখা হতো। কিন্তু এইচ.এম এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে (সি.এম.এল.এ) শপথ নেওয়ার সময়ই তাড়াহুড়া করে জিয়াউর রহমানের ফটো এবং সোনার আবরণে গঠিত ধানের শীষ প্রতীক টেবিল থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলে এবং তাড়াহুড়ো করে এরশাদের একটি ফটো অফিসের মধ্যে টাঙ্গিঁয়ে রাখা হয়। তারপর অতি অল্পদিনের মধ্যে এরশাদের ফটোসহ কোটপিন অধঃস্থনদের উপহার দেয়া হয়। সেই সময়ে এরশাদ দল ঘটন না করার কারণে এরশাদের দলের প্রতীক সোনার লাঙ্গল বানিয়ে টেবিলে রাখতে পারেনি। শুনা যায়, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের এ সমস্ত ভক্ত, অনুরুক্ত কর্মকর্তারাই নাকি এক সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতার সময় টেবিলে শেখ মুজিবুর রহমানের ফটো এবং দলের প্রতীক নৌকাকে সোনার নৌকা বানিয়ে টেবিলে রাখতো। এমনকি মুজিব কোট পরিধান করতো।
এ ধরণের ঘটনা এখন যে আর নেই তেমন নয়। বসন্তকালের কোকিল, মৌসুমী পাখী ও সাইবেরীয়ান বার্ডসদের মতো সুবিধাবাদীরা মৌসুমী পাখরি মতো আনাগোনা শুধু দলেই নয়, অফিস আদালতেও ওদের কমতি নেই। এ সমস্ত মৌসুমী পাখীরা দোয়েল, কোয়েল, পাপিয়াদের মতো বসন্তকালে বিচরন করে থাকে। যেমনিভাবে সাইবেরীয়াতে শীত কমার পর দলে দলে সাইবেরীয়ান পাখিরা পাখা মেলে সাইবেরীয়াতে পাড়ি জমায়, তেমনি মৌসুমী পাখী ও বসন্তকালের কোকিলরাও সময়মত মধু আহরণ করে, গাড়ী বাড়ী করে একসময় সাইবেরীয়ান পাখীদের মতো দলে দলে পাখা মেলে উড়ে যায়। সমসাময়িক ইতিহাস ও বাংলাদেশের ৪৫ বছরের ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করলে ৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের আগে পরে খন্দকার মোস্তাকের ৮৩ দিনের শাসন, জিয়াউর রহামনের আগমন, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে নিহত, বিচারপতি ও সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের ৮২ সালের ২৪ মার্চ অসাংবিধানিকভাবে বিদায়, ৮২ সালের ২৪ মার্চ লেঃ জেঃ এরশাদের সামরিক শাসক হিসেবে আগমন, ৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার ও গণদুশমন হয়ে এরশাদের বিদায়, তত্ত্বাবধায়ক আমলে ৯১ এর নির্বাচন, ৯৬ এর ১৫ ফেব্র“য়ারী, ৯৬ এর ১২ জুন, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং তার আগে ৭৩, ৭৯, ৮৬ ও ৮৮ এর নির্বাচন, ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্ট ও ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন থেকে অদ্যাবধি এদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, শাসন, প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে একই অঙ্গে হরেক রূপ, বিনিআসহকলা (VIBGYOR), মৌসুমী পাখি ও বসন্তকালের কোকিলদের সম্পর্কে জানতে কোন লেখক, নিবন্ধক ও প্রাবন্ধিকের দ্বারস্থ না হয়ে শুধু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণই যথেষ্ট বলে অনেকেরই ধারণা। কিন্তু ফ্যাসিবাদী অগণতান্ত্রিক নিষ্টুর শাসকেরা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যায় বলে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতো তবে বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কোন অবস্থাতে মৌসুমী পাখী ও বসন্তকালের কোকিলদের ব্যাপারে আগাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হতো না। তাছাড়া স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মধ্যে এ নিয়ে কারো চিন্তাও করতে হতনা। আজ দেশের অন্যান্য সমস্যা, উন্নয়ন, জঙ্গিবাদের সমস্যা ও সর্বক্ষেত্রে সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী, বসন্তকালের কোকিল ও মৌসুমী পাখীর কথা নিয়ে চিন্তা করাই অভিসম্পাদ। তাই বলতে হয় That nobody takes lesson from history is itself a lesson of history. অর্থাৎ কেউ যে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনা, সেটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
এ দেশের মানুষ ৪৫ বছরে অনেক কিছু দেখেছে এবং দেখছে। মানুষ চায় শান্তি, স্বস্থি, নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সকলের সমন্বিত উন্নয়নের কর্মপ্রণয়ন।
যেমনিভাবে রাজনীতি থেকে মৌসুমী পাখীদের বিদায় বার্তা দরকার, তেমনিভাবে ৪৫ বছর যাবত সাপের খোলসের মতো রূপ পরিবর্তন করে বারংবার যারা হাবাগোবা সেজে একসময় মহীরুহ হয়ে যারা নিজেদেরকে ধারণ করে, দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, থেকে সর্বত্র নাক গলিয়ে সবকিছুকে ক্ষত বিক্ষত করে, লুঠে পুটে নিজেদেরকে কলাগাছ থেকে বঠগাছ বানানোর কর্ম কৌশল প্রয়োগ করার সিদ্ধহস্ত, তাদেরকেও মৌসুমী পাখী ও বসন্তের কোকিলের মতো গেট আউটই ক্ষুদ্ধ বিক্ষুদ্ধ শ্রেণী পেশার ও সাধারন মানুষের প্রত্যাশা। আমরা যা বলি তা করিনা, যা করি তা বলিনা। বাস্তবতার প্রতিফলনই হোক আমাদের উচ্ছাস, ধ্বনি, প্রতিধ্বনি ও প্রতিশ্রুতির জয় ঝংকার।
লেখক: কলামিষ্ট, উকিলপাড়া, কিশোরগঞ্জ- ২৩০০।