Tue. Apr 29th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৬: আজ ১৭ নভেম্বর ভূঞাপুরের ছাব্বিশা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১সালের এইদিনে বর্বর হানাদার বাহিনী ঘটিয়েছিল বিভীষিকাময় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৩৯টি তাজাপ্রাণ। গুরুতর আহত হয় প্রায় ৫০জন। পুড়িয়ে দেয় সাড়ে ৩শ’ বাড়ি।

এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা মনে হলে আজও শিউরে উঠে এ গ্রামের স্বজনহারা মানুষেরা। তারই একজন বেলাল হোসেন। তাঁর চোখের সামনে পাকিস্তানী হানাদাররা গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে বাবা, মা, দু’চাচা ও ১০দিন বয়সের শিশু বোনকে (একই পরিবারের ৫জন)। সেদিন স্বজনদের লাশের আড়ালে লুকিয়ে থেকে বেঁচে গিয়েছিল বেলাল। সে যন্ত্রনা আজও বেলালকে তাড়িয়ে বেড়ায়। শুধু বেলাল হোসেন নয়, ভূঞাপুরের ছাব্বিশা গ্রামের কেউ ভুলতে পারেননি সেদিনের বর্বরতার কথা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা এ গ্রামে বর্বর আক্রমণ চালিয়ে ৩৫জন নারী পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। গুরুতর আহত হয় অর্ধ শতাধিক। প্রায় সাড়ে ৩শ ঘর-বাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে সেদিন ছাব্বিশা গ্রামকে পরিণত করেছিল বিরাণভুমিতে। ওই দিনই পার্শবর্তী বেতুয়া পলশিয়া গ্রামে ৩হিন্দু ও এই দূর্যোগের বার্তা বাহককে গুলি করে হত্যা করে।

এ হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৭১সালের ১১আগস্ট মুক্তিবাহিনীরা ভুঞাপুরের সিরাজকান্দিতে ধলেশ্বরীর মোহনায় যমুনা নদীতে পাকহানাদার বাহিনীর অস্ত্র বোঝাই ‘এস ইউ ইঞ্জিনির্য়াস এলসি-থ্রি’ এবং ‘এলটি রাজন’ নামক ২টি জাহাজ দখল করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার শেষে জাহাজ ২টি ধ্বংস করে দেয়। তারপর থেকেই ভূঞাপুরের যমুনা তীরবর্তী গ্রামগুলো পাকহানাদার বাহিনীরা বিশেষ নজরে রাখে।

ছাব্বিশা রণক্ষেত্রের সন্মুখযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: জিয়াউল হক জিয়া জানান, ৭১সালের ১৭নভেম্বর সিগনালম্যান আব্দুল লতিফ খানের তথ্যেও ভিত্তিতে কমা-ার আব্দুল হাকিম, হাবিবুল হক খান বেনু, আসাদুজ্জামান আরজু ও খন্দকার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর ৪কোম্পানির যোদ্ধারা উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের কালীগঞ্জ গ্রামে অবস্থান করছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের এই অবস্থানের খবর জানতে পেরে সেদিন সকাল ১১টার দিকে সিরাজগঞ্জ হতে যমুনা নদী পার হয়ে পাকবাহিনী ছাব্বিশার পশ্চিমের গ্রাম শালদাইর ব্রীজের কাছে অবস্থান নেয়। পরিকল্পিতভাবে হানাদারদের অপর একটি দল অবস্থান নেয় ছাব্বিশা গ্রামের উত্তর পশ্চিম পাশে। পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। এতে পাকবাহিনী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে শুরু করে ভারি অন্ত্রের গোলাবর্ষণ। সারাদিন চলে গুলি বিনিময়। হানাদার বাহিনীর প্রচ- আক্রমনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকবাহিনী ছাব্বিশা গ্রামে প্রবেশ করে চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।

সেদিনের ছাব্বিশা গ্রামের পাক বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে বেঁচে যাওয়া সাহেব আলী জানান, রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদাররা বাড়ী ঘরে ঢুকে টেনেহিচড়ে নিয়ে হত্যা করে নিরিহ মানুষদের। তাদের হাত থেকে দুধের শিশুও রেহাই পায়নি। বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করে আগুনে নিক্ষেপ করেছে হানাদাররা।

ছাব্বিশা গ্রামে গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন ৩৮জন। তার মধ্যে ৩৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হচ্ছেন- বিশা মন্ডল, মনির উদ্দিন, ওমর আলী, সাজেদা বেগম, রাবেয়া খাতুন, খালেদা খাতুন, ইসমাইল হোসেন, মমতাজ উদ্দিন, সমশের আলী, ছমিরন নেছা, আয়নাল হক , হাফেজ উদ্দিন, দানেশ আলী, তাসেন আলী, হায়দার আলী, সেকান্দর আলী, রমজান আলী, কুরবান আলী, মাহমুদ আলী, আবুল হোসেন, ইউসুফ আলী, শফিকুল ইসলাম, মোতালেব হোসেন, ইয়াকুব আলী, শুকুর মাহমুদ মন্ডল, বাহাজ উদ্দিন মন্ডল, আঃ গফুর, রাবেয়া খাতুন, জহির উদ্দিন, সিরাজ আলী, সোনাউল্লাহ, হোসনে আরা খাতুন ও মো: জায়েদ আলী।

এছাড়া পার্শবর্তী বেতুয়া পলশিা গ্রামে যোধিষ্ঠী চন্দ্র সরকার ওরফে খুদি শীল, নকুল চন্দ্র সরকার ওরফে অনীল শীল ও নিশি কান্ত সরকার নামক তিন হিন্দু ও এ দুর্যোগের বার্তা বাহকে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী উজ্জ্বল নক্ষত্র এ শহীদদের স্মরণে ভূঞাপুর পৌরসভার উদ্যোগে ছাব্বিশা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একটি নাম ফলক উন্মোচণ করা হলেও শহীদদের কবরগুলো আজও পরে আছে অবহেলা-অযত্নে। যা এখন পর্যন্ত সরকারী ভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মামুন তরফদার বলেন, ‘মহান স্বাধীনতায় জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের কবরগুলো অবিলম্বে সরকারীভাবে সংরক্ষণ করা উচিত। এসব শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে না স্বাধীনতার জন্য জাতি কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছে।’

অবোধ নিস্পাপ শিশু, বিন¤্র কিশোরী, লাজরক্তিম গৃহবধূ কিংবা স্নেহময়ী জননীর চোখের সামনে আপনজনের নৃশংস হত্যাকা- ভূঞাপুরের আকাশ বাতাস বেদনাবিধুর করে তুলেছিল সেই দিন। আজও ১৭নভেম্বর এলে এ গ্রামে নেমে আসে শোকেরছাঁয়া, বোবা কান্নায় নিথর হয় এলাকার মানুষ।