খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০১৬: ঢাকা শহরে অনেক আগে থেকেই এই ‘ইয়ান তুন খাই যান’ নামে স্ট্রিট ফুডের দোকান চালু আছে।
আমার জানামতে চাইনিজ কিংবা থাই খাবারের ভ্রাম্যমান কার্টগুলোর কোন একটা সর্বপ্রথম এই নামে ব্যবসা শুরু করে। বিদেশি খাবারের সাথে মিলিয়ে নামটার মধ্যেও কিছুটা বিদেশি (চাইনিজ) আমেজ আনা হলেও মূলত এটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষা, যার অর্থ ‘এখান থেকে খেয়ে যান!’
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বিপিএলের চট্টগ্রাম পর্ব শেষ হবার পর এই সময়ে হঠাৎ করেই এই লাইনটা নতুন করে মাথায় উঁকি-ঝুকি মারা শুরু করেছে!
এখন কথা হচ্ছে, বিপিলের সাথে এই ইয়ান তুনের কি সম্পর্ক? বিশেষ করে এই ‘ইয়ান’ এর? সেটাই এই লেখায় আলোচনার চেষ্টা করবো। বিপিএল যারা নিয়মিত অনুরসণ করেন, তাদের অনেকে প্রথম দুই আসরে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের শিরোপাজয়ী কোচ ‘ইয়ান’ পন্ট সম্পর্কিত কোনকিছু ধারণা করে নিতে পারেন।
না ভাই, আমার আলোচনার ‘ইয়ান’ও বিদেশি কেউ নন, নির্ভেজাল দেশি ছেলে-মেয়েরা!
ইদানীং ফেসবুক খুললেই নানান রকম ‘ইয়ান’ চোখে পড়ে! কেউ সাকিবিয়ান (সাকিব+ইয়ান), কেউ মাশরাফিয়ান (মাশরাফি+ইয়ান), কেউ তামিমিয়ান (তামিম+ইয়ান) আবার কেউবা মুশিবিয়ান! মূলত ‘তরুণ প্রজন্ম’ তথা ‘ইয়াং জেনারেশনে’র ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যেই এই ‘ইয়ান জেনারশন’ এর বসবাস!
একটা সময় মনে হতো এই হরেক রকমের ‘ইয়ান সম্প্রদায়’ আসলে দারুণ একটা ব্যাপার। বিশেষ কোন একজন খেলোয়াড়কে পাগলের মতো ভালবাসা, তার দুঃসময়ে পাশে থাকা, তার হেটারদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজগুলোতে বরাবরই অগ্রগামী ভূমিকা রেখে এসেছে ‘ইয়ান জেনারেশন’!
এই যেমন আফগানিস্থানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেও স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দলের বিপর্যয়ের মধ্যেও একদল সাকিবিয়ানের ক্রমাগত সমর্থনের দৃশ্য আবেগাপ্লুত করেছিল আমাকে।
কিন্তু ইদানীং এই ‘ইয়ান সম্প্রদায়’ এর একটি ‘উগ্র’ অংশের আচার-আচরণ পুরো ব্যাপারটি নিয়েই নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
একজন সাকিবিয়ান হবার অর্থ যদি এই হয় যে সাকিব যা বলবেন, যা করবেন তার সবকিছুই ঠিক, আর অন্য সবাই ভুল; তবে সেটা ক্ষতিকর। একজন মাশরাফিয়ান হবার অর্থ যদি এই হয় যে, ‘মাশরাফি মানেই ক্রিকেট, শুধু মাশরাফি মানেই বাংলাদেশ’ সেটাও আশঙ্কাজনক!
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার যেটা দেখা যাচ্ছে, একজন সাকিবিয়ান কাল্পনিক বিরোধ খুঁজে নিয়ে একজন মাশরাফিয়ানের সাথে গ্যাঞ্জাম করছেন, গালি দিচ্ছেন। আবার মাশরাফিয়ানরা ডিটারজেন্ট ছাড়াই ধুঁয়ে ফেলছেন সাকিবিয়ানদের। আর এই দ্বন্দ শুধু সাকিবিয়ান-মাশরাফিয়ানদের মধ্যেই না। যাবতীয় ‘ইয়ান’রাই তাদের স্বপ্নের তারকার সম্মান রক্ষার নামে এক অর্থে সেই তারকার সম্মানহানিরই কারণ হচ্ছেন!
যেই মাশরাফি সাকিবকে আপন ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন, যেই সাকিব প্রাণপ্রিয় বড় ভাই মাশরাফির সাথে কখনো গলা উচিয়ে কথা পর্যন্ত বলেন না; সেই সাকিব আর মাশরাফির মধ্যেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার উপক্রম করছেন কিছু তথাকথিত সাকিবিয়ান-মাশরাফিয়ান!
মূলত এই ‘ইয়ান’রা যেন ফেসবুকে ফ্রি-তে গালি বিলানোর ভ্রাম্যমান দোকান খুলেছেন, ‘ইয়ান তুন গালি খাই যান!’
তারা কি একবারও কল্পনা করে দেখেছেন কি জঘন্য আর নোংরা এক অসুস্থ যুদ্ধ তারা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনের চালিয়ে যাচ্ছেন?
বরিশালের মুশফিক যখন রাজশাহীকে হারিয়ে তীব্র আক্রোশে উদযাপন করেন, তখন ফেসবুকে মুশিবিয়ান-সাব্বিরিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অথচ এর কিছুক্ষণ পরেই যে সেই মুশফিক আর সাব্বির কাঁধে কাঁধ রেখে হাসিমুখে মাঠে চক্কর দিয়ে বেড়ান, সেই দৃশ্য যেন কোনভাবেই এদের দৃষ্টিগোচর হয় না!
খেলার মাঠে সাকিবকে এক ওভারে মাশরাফি ৪টা ছক্কা মারলেই কিছু সাকিবিয়ানের সাকিবানুভুতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অথচ দীর্ঘদিন আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পর প্রথম দেখায় সাকিব-মাশরাফি যে একে অপরকে খুশিতে জড়িয়ে ধরেন বা সাকিব ‘কোন কথাই শুনতে চাই না, আসতেই হবে’ ভঙ্গিতে দাওয়াত দিয়ে তার বাসায় মাশরাফিকে ডিনার খাওয়ান; এইসব খবর কি এইসব সমর্থকরা কখনো জানতে পেরেছে?
এসব আচরণ দেখতে দেখতে আজকাল এই ‘ইয়ান’ নামধারী সমর্থকদের বড্ড বেশি ক্ষতিকর মনে হয়। একজন মাশরাফি আর কতদিনই বা বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলবেন? আজ হোক কাল হোক তিনি অবসর নেবেন। তখন কি মাশরাফিয়ানরা ক্রিকেট খেলা দেখাই ছেড়ে দেবেন? কিংবা একজন সাকিবের অবসরের পরই কি সব সাকিবিয়ানরা ক্রিকেট থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেবেন? নাকি নতুন কোন পছন্দের ক্রিকেটার খুঁজে নিয়ে নতুন করে নতুনিয়ান হবেন!
.
তাই ‘ইয়ান’দের উদ্দেশ্যে বলি, ব্যক্তির অন্ধ ভক্ত না হয়ে পুরো বাংলাদেশ দলেরই অন্ধ ভক্ত হতে চেষ্টা করুন, ভাই। তামিমিয়ান, সাব্বিরিয়ান না হয়ে হয়ে উঠুন এক একজন টাইগারিয়ান। মনে রাখবেন, সাকিব, তামিম, মাশরাফিরা একসময় জাতীয় দলে থাকবেন না, সেদিনও আমাদের একটি জাতীয় দল থাকবে, থাকবে ১১টি টাইগার। সেদিন যেন আপনার বুক ফুলিয়ে নিজের পরিচয় দিতে ইতস্তত করতে না হয়!