খোলা বাজার২৪, শনিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬: আজ ৩ ডিসেম্বর, ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে ঠাকুরগাঁও মহকুমা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের জনগণ ওই দিন ভোরে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। শুরু হয় বিজয়ের উল্লাস।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান জানান, পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা মুক্তাঞ্চল থেকেই পরিচালিত হয় চূড়ান্ত লড়াই। ১৫ এপ্রিলের পর ঠাকুরগাঁও এলাকায় শুরু হয় হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট আর বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি শহরের ইসলাম নগর থেকে ছাত্রনেতা আহাম্মদ আলীসহ ৭ জনকে হানাদার বাহিনী ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে ধরে এনে আটক করে রাখে। পর বেয়নেট চার্জ করে হত্যার পর তাদের লাশ শহরের টাঙ্গন ব্রিজের পশ্চিম পাশে গণকবর দেয়। একইভাবে তৎকালীন এমপি আলহাজ্জ ফজলুল করিমের কয়েকজন চাচাতো ভাইসহ ৬ জনকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ২৭ মার্চ পাকবাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হন রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করায় শিশু নরেশ চৌহানকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনীর সদস্যরা।
১৭ এপ্রিল সেখানে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ২ হাজার ৬’শ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে পাথরাজ নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে। এদিনে জগন্নাথপুর, গড়েয়া শুখাপনপুকুরী এলাকার কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ ভারত অভিমুখে যাওয়ার সময় স্থানীয় রাজাকাররা তাদেরকে আটক করে। এরপর মিছিলের কথা বলে পুরুষদের লাইন করে পাথরাজ নদীর তীরে নিয়ে যায় এবং পাক হানাদাররা ফায়ার করে হত্যা করে তাদের। স্বামী হারিয়ে সেদিনের বিভৎস ক্ষত নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন ৪ শতাধিক নারী।
দ্বিতীয় গণহত্যা চালানো হয় রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়াদিঘীর পাড়ে। মালদাইয়া বলে পরিচিত স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার নিরীহ লোকজনকে ধরে নিয়ে যেতো ওই পুকুরের পাড়ে। সেখানে একটি শিমুল গাছের সঙ্গে হাতে পায়ে লোহার পেরেক গেঁথে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে বর্বর নির্যাতন চালাতো লোকজনের উপর। তারপর লাইন করে দাঁড় করিয়ে সাধারণ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হতো। মানুষের রক্তে এক সময় লাল হয়ে উঠে ওই পুকুরের পানি। তাই পরবর্তীতে এ পুকুর খুনিয়াদিঘী নামে পরিচিত হয়ে উঠে বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা বাবলু।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুবোধ চন্দ্র রায় জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তি বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয় জুলাই মাসের প্রথম দিকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বেশ কিছু ব্রিজ ও কালভার্ট উড়িয়ে দেয় তারা।
দালাল রাজাকারদের বাড়ি ও ঘাঁটিতে হামলা চালায়। নভেম্বর মাসের ৩য় সপ্তাহ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক অভিযান চালায়। সে সময় ছিল তীব্র শীত। মুক্তিযোদ্ধার দেশ মাতৃকার জন্য শীত-বর্ষা উপক্ষো করে দেশের জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে।
মুক্তিযোদ্ধা মন্টু দাস জানান, পাকবাহিনী বহু মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের বাঘের খাঁচায় ফেলে হত্যা করেছিল। ১২ নভেম্বর ঠাকুরগাঁয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে দেশের জন্য বাঘের খাঁচায় জীবন দিতে হয়েছিল। সে সময় ঠাকুরগাঁয়ের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন তসলিম উদ্দীন (এস.ডি.ও) শখ করে তার বাংলোতে দুটো চিতাবাঘ পুষতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ওই চিতাবাঘ দুটোকে তাদের ক্যাম্প বর্তমান বিজিবি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে ১০ নভেম্বর গ্রেফতারের পর অনেক অত্যাচার করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করার জন্য। কিন্তু শত অত্যাচার সহ্য করেও সালাহউদ্দিন কোনো প্রকার তথ্য পাকসেনাদের দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে সর্বশেষ ১২ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ১১টায় হাত বাঁধা অবস্থায় মেজর জামানের নির্দেশে বাঘের খাঁচায় ছুড়ে দিয়েছিল।
ভারপ্রাপ্ত জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদরুদ্দোজা বদর জানান, মুক্তি বাহিনীর যৌথ অভিযানে পঞ্চগড় মুক্তিবাহিনীর দখলে আসলে পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এরপর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে। মিত্রবাহিনী যাতে ঠাকুরগাঁও দখল করতে না পারে সেজন্য পাকসেনারা ৩০ নভেম্বর ভূল্লরী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকায় সর্বত্র বিশেষ করে ইক্ষু খামারে মাইন পুঁতে রাখে। মিত্রবাহিনী ভূল্লরী ব্রিজ সংস্কার করে ট্যাংক পারাপারের ব্যবস্থা করে।
১ ডিসেম্বর ভূল্লরী ব্রিজ পার হলেও মিত্রবাহিনী যত্রতত্র মাইন থাকার কারণে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে পারেনি। ওই সময় শত্রুদের মাইনে ২টি ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর এফ এফ বাহিনীর কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ২ ডিসেম্বর সারারাত প্রচণ্ড গোলাগুলির পর শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে। ৩ ডিসেম্বর ভোররাতে শত্রুমুক্ত হয় ঠাকুরগাঁও। তখন মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের জনগণ মিছিলসহ ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়।
বিজয় ছিনিয়ে আনতে ১০ হাজার নারী পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাশবিক নির্যাতনের শিকার ২ হাজার মা-বোন।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জেলা সভাপতি সেতারা বেগম জানান, ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিবছরের মতো এ বছরও ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সকালে দিবসের উদ্বোধন শেষে আনন্দ র্যালি, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।