Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

2kখোলা বাজার২৪, বুধবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬: ‘৭ ডিসেম্বর’ নোয়াখালী হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল নোয়াখালী জেলা।

আজ বুধবার দিনব্যাপী মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিট ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের উদ্যোগে মুক্ত মঞ্চে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিজয় র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ঊনিশো একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশে নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সেই দিন গভীররাতে ঢাকা থেকে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মনজরুল করিম, বঙ্গবন্ধুর প্রথম সারির সহচর আবদুল মালেক উকিল ও তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের রিপোর্টার কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে গোপনে মেসেজ আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।

এর পর পরই নোয়াখালী টাউন হল হয়ে উঠে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ট্রোল রুম। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত নোয়াখালী ছিল শক্র মুক্ত। পরে ২৬ এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী একটি দল নোয়াখালী প্রবেশ করে মাইজদী পিটিআইতে ঘাঁটি স্থাপন করে, তৈরি করে টর্চার সেল। জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে সেখানে তারা নির্যাতন চালাতো।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম ফজুলল হক বাদল সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে জানান, ৬ ডিসেম্বর ফেনী ও লক্ষ্মীপুরসহ তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল শক্রমুক্ত হতে থাকে। এরমধ্যে ৭ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী যৌথভাবে নোয়াখালী জেলা শহর ঘিরে ফেলে।

নোয়াখালী জেলা বিএলএফ কমান্ডার মাহমদুর রহমান বেলায়েত প্রত্যেকটি থানা কমান্ডারদের নির্দেশ দেন প্রত্যেক থানা সদর দপ্তর আক্রমণ করে পুরোপুরি শত্রু মুক্ত করতে। জেলা শহরের পিটিআই দখলের দায়িত্ব পড়ে সদরের সব মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর।

ওই দিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ফজলে এলাহী, মমিন উল্লাহ, মিজানুর রহমান, ফজলুল হক বাদল, মোজাম্মেল হক মিলন, জিএস কাশেম, রফিক উল্লা কমান্ডার, মাইন উদ্দিন জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ উল্যাহ, মোশারফ হোসেন, ভিপি জয়নাল আবেদীন, আবুল কাশেম ব্যাংকার, আলী কারী করিম উল্যাহ, কামাল উদ্দিন আহাম্মদ চেয়ারম্যান, জয়নাল আবেদীন চেয়ারম্যান, লেদু মিয়া চেয়ারম্যান, সফিকুর রহমান, মোস্তফা কামাল, আজিজুর রহমান ইকবাল, মমতাজুল করিম বাচ্চু ও মিঞা মোহাম্মদ শাহজাহানসহ মুক্তিবাহিনীর কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধা জেলা শহরের রাজাকার আল বদরদের ক্যাম্প নাহার মঞ্জিল, মাইজদী কোর্ট রেল স্টেশন, হরিনারায়ণপুর, দত্তেরহাট রাজাকার ক্যাম্প ও পাক হানাদার বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি পিটিআইর হোস্টেল ভবনে আক্রমণ চালায়।

পিটিআই সেন্টার আক্রমণ করতে এসে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের প্রবেশ পথে নাহার বিল্ডিং রাজাকার ক্যাম্প, মাইজদী কোর্ট স্টেশন রাজাকার ক্যাম্প, দত্তের হাট রাজাকার ক্যাম্প গুড়িয়ে দেয়। তারা জামে মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত রেনু মিয়া কন্ট্রাক্টরের বাড়ি থেকে বর্তমান নতুন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। জেলার উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চল থেকে সব মুক্তিযোদ্ধা শহরে এসে বাকি তিন দিক ঘিরে ফেলে।

পিটিআই এলাকাটি সংরক্ষিত এলাকা। পাক বাহিনী রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের জবাব দেয় ৩০৩ রাইফেল দিয়ে।

এদিকে, ফেনী ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জাফর ইমাম মাইজদী পিটিআই যুদ্ধের খবর পেয়ে তার একটি সেকশন নিয়ে দুপুরে এসে মাইজদীতে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সব অবস্থান এবং শত্রুর অবস্থান জেনে তাদের আস্তানায় দু’টি দুই ইঞ্চি মর্টার শেল নিক্ষেপ করলে সঙ্গে সঙ্গে রাজাকাররা ব্রাশফায়ার শুরু করে।

ওই সময় কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং অনেকে পালিয়ে যায়। শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ হন নোয়াখালী কলেজের অধ্যাপক আবুল হাসেম, ছাত্র নজরুল ইসলাম স্বপন, সরকারি কর্মকর্তা আবদুল জলিল, নাজির বসু মিয়া ও একজন অজ্ঞাতপরিচয় আনসার সদস্য।

৭ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত একটানা ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

একই সময় সুবেদার লুৎফুর রহমানের নেতৃৃত্বে সুবেদার শামছুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধারা বেগমগঞ্জে টেকনিক্যাল হাই স্কুলসহ বিভিন্ন ক্যাম্পের শত্রুদের পরাজিত করে বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেয়। শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী।

সেই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা হাতে নিয়ে জেলা শহর মাইজদীতে হাজারো মুক্তিকামী মানুষ জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে।

তাই ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত দিবস স্মরণে পিটিআই ভবনের প্রধান গেটের সামনে ‘মুক্ত নোয়াখালী’ নাম দিয়ে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়।

পিটিআই গেটে মুক্ত নোয়াখালী নামে যে সৌধটি দাঁড়িয়ে আছে এটি ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার স্বাক্ষর বহন করে। নোয়াখালী মুক্ত দিবস হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রেরণার উৎস। এটাই এখানকার মুক্তিকামী জনগণের প্রত্যাশা।