Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

16kখোলা বাজার২৪, শনিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬: কিশোরী মেয়েটির তলপেটে ব্যথা হয় প্রতি মাসে! সে দিকে বাড়তি মনোযোগ নেই কারোর! ও তো হয়েই থাকে, এমন একটা ভাব প্রায় সবার। হয় মুখ বুজে সহ্য করার পরামর্শ, নয়তো পাড়ার দোকান থেকে পেনকিলার কিনে এনে দেওয়া!

অথচ গবেষকরা এখন বলছেন, মেয়েদের তলপেটে ঋতুস্রাবজনিত ব্যথা বুকে ব্যথার থেকে কোনও অংশে কম মারাত্মক নয়। লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন গুইলেবাও সম্প্রতি গবেষণা করে দেখেছেন, ঋতুস্রাবজনিত ব্যথার তীব্রতা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার মতোই খারাপ। তা হলে অবহেলা কেন? গুইলেবাও তার জন্য কাঠগড়ায় তুলছেন সমাজে লিঙ্গবৈষম্য এবং পুরুষতন্ত্রকেই।

গুইলেবাও-এর সুরে সুর মিলিয়ে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই স্বীকার করছেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন ঋতুকালীন যন্ত্রণাকে খাটো করে দেখার প্রবণতা রয়েছে, সেই একই প্রবণতা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যেও ঢুকে রয়েছে। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে নিবিড় গবেষণাই হয়েছে খুব কম। নারীবাদী লেখক গ্লোরিয়া স্টেইনহেম এক বার লিখেছিলেন, মেয়েদের ঋতুচক্র নিয়ে ঠাট্টাতামাশার শেষ নেই। এটা যেন নারীর দুর্বলতারই একটা চিহ্ন। কিন্তু পুরুষের যদি ঋতুস্রাব হতো, তখন দেখা যেত সেটা যেন একটা বিরাট কৃতিত্বের ব্যাপার!

প্রায় এই কথাটাই কিন্তু বলেছেন গুইলেবাও। তাঁর মতে, পুরুষমানুষের ঋতুস্রাব হয় না বলেই সেই সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়টিও চিকিৎসার গবেষণায় গুরুত্ব পায়নি। যদি পেত, তা হলে দেখা যেত ঋতুকালীন পেটে ব্যথা বুকে ব্যথার মতোই বিপজ্জনক হতে পারে। একই অভিজ্ঞতা পেনসিলভানিয়া স্টেট কলেজ অব মে়ডিসিন-এর শিক্ষক রিচার্ড লেগ্রো-র। তিনি দাবি করেছেন, ঋতুকালীন ব্যথা নিয়ে তিনি তিন-চার বার গবেষণার প্রস্তাব জমা দিয়েছিলেন, গ্রাহ্য হয়নি।

কারণ, বিষয়টাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করা হয়নি। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকদের মতে, ঋতুকালীন ব্যথাকে অবজ্ঞা করার বদভ্যাস থেকে মেয়েদের ব্যথা-যন্ত্রণাকে সার্বিক ভাবেই হেয় করার প্রবণতা তৈরি হয়। মেয়েরা অনেক কিছুই বাড়িয়ে বলেন, অতিনাটকীয় করে তোলেন— এটাই চালু ধারণা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি সমীক্ষায় তাই ধরা পড়েছে, পুরুষেরা পেটে ব্যথার কথা বললে গড়পড়তা ৪৯ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসককে ডেকে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই সময়টা লাগে ৬৫ মিনিট!

শুধু কি চিকিৎসক? মেয়েদের নিজেদের মধ্যেও প্রতি মাসের এই রুটিন ব্যথা নিয়ে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব আছে। কলকাতার বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরাও বলছিলেন, ‘‘ঋতুস্রাবজনিত ব্যথা নিয়ে কথা বলতে এখনও মহিলাদের মধ্যেই সংকোচ আছে।’’ কেউ কেউ আবার ব্যথার থেকে নিষ্কৃতি পেতে মুড়ি-মুড়কির মতো খান পেনকিলার। এতে ফল হয় হিতে বিপরীত। সাময়িক ভাবে ব্যথা কমলেও সমস্যা আরও জটিল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

অথচ ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, ঋতুস্রাবের ব্যথার উত্স এনড্রোমেট্রিওসিস নামক একটি বিশেষ রোগ। সময় মতো ডাক্তারের পরামর্শ নিলে অবস্থার অবনতি ঠেকানো যায়।

কী করবেন
>ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
>এনড্রোমেট্রিওসিসের চিকিত্সা করান।
>গর্ভ-নিরোধক ওষুধ ভাল ফল দেয়।
>ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই ওষুধ খান।

কী করবেন না
>মাটিতে বসা এড়িয়ে চলুন।
>ভারী জিনিস তুলবেন না।
>হাঁচি-কাশিতে কষ্ট বাড়ে। নজর রাখুন।
>কোষ্ঠকাঠিন্যেও কষ্ট বাড়ে। নজর রাখুন।

ঋতুস্রাব নিয়ে মহিলাদের মধ্যে চিকিত্সাগত দিক দিয়ে সচেতনতাও এখনও সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। ঋতুস্রাব নিয়ে সমাজের গোঁড়ামিকে নাড়া দিতেই বেশ কয়েক মাস আগে কিছু ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রূপি কৌর। তুলেছিলেন দুনিয়া জুড়ে বিতর্কের ঝড়।

দু-দুবার তার সেই ছবি ইনস্টাগ্রাম থেকে ডিলিট করে দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-সহ পৃথিবীর নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছিল আন্দোলন। মেয়েরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন গাছের গায়ে, দেয়ালে স্যানিটারি ন্যাপকিন টাঙিয়ে। ঋতুস্রাবকে ‘সমস্যা’ বলে চিহ্নিত করায় এক পুরুষ সাংবাদিককে একহাত নিয়েছিলেন অভিনেত্রী পরিণীতি চোপড়া।

সামাজিক জড়তা কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য-সচেতনতার দিকটি যাতে সামনে আসে, তার জন্য অবশ্য কাজ করছেন অনেকেই।

তামিলনাড়ুর অরুণাচলম মুরুগানন্থম বা সুন্দরবনের স্কুলশিক্ষক চন্দন মাইতির কথা খবরে এসেছে। গ্রামের মেয়েদের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেওয়ার সরকারি প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। তবু গ্রাম হোক বা শহর, ঋতুকালীন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এবং গবেষণা, দুয়েরই এখনও যে অনেকটা পথ চলা বাকি, সেটা এত দিনে আন্তর্জাতিক মহলেও কবুল করা হল।