Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

14kখোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬: আজ ১৫ ডিসেম্বর। উত্তরাঞ্চলের চার লাইন জংশন খ্যাত দিনাজপুরের পার্বতীপুর ১৯৭১ সালের এ দিনে হানাদার মুক্ত হয়। শান্তিকামী মানুষ ৭ মার্চের পর সারা দেশের মত পার্বতীপুরেও শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস আদালত, স্কুল-কলেজের শিা কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ট্রেন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ২৩ শে মার্চ শহরের অবাঙ্গালীদের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক

আচরনে ক্ষুদ্ধ হয়ে গ্রাম-গঞ্জের সাধারন মানুষ শহর ঘেরাও করে সিদ্দিক মহল্লায় অগ্নিসংযোগ করে।

এ সময় অবাঙ্গালীরা নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ব্যাপক গুলি চালায়ে যাদের হত্যা করে তাদের মধ্যে ২৪ ও ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীসহ ১১ জন, ব্যবসায়ী ৪ জন কর্মচারী, কাশিয়া তেলীর পরিবারের ৪জন সদস্য, তৎকালীন সিনেমা হলের ম্যানেজারের গোটা পরিবার, ওয়াহিদ কোম্পানীর দু’জন কর্মচারী, পার্বতীপুর থানার এ এস আই গোলাম মোস্তফার পরিবারের সকল সদস্য, ক্যাপ্টেন ডাক্তারের পুত্র ডাঃ সামসাদ সহ অসংখ্য লোককে কয়লার ইঞ্জিনে বয়লারে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

এ গণহত্যার পর বাঙ্গালীরা ক্রোধে ফেটে পরে। ২৬ মার্চ দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত ট্রেনিং না থাকায় দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্র, শিক, সরকারী কর্মচারী, যুবদল সংঘবদ্ধ হতে শুরু করল। এর পর আড়াইশ’ তৎকালীন বেঙ্গল রেজেমেন্ট পুলিশ আর আনছার বাহিনীর সদস্য এসে তাবু ফেলে খোলাহাটী আটরাই গ্রামে।

তাদের নেতৃত্বে চিল ক্যাপ্টেন আনোয়ার। ডঃ আব্দুল বারী ও আব্দুল মতিনের বাড়ী ও তৎসংলগ্ন এলাকা তারা ব্যবহার করে। তারা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে সংগ্রামী দল গঠন করে। এদের হাতে ধরা পরে একজন অবাঙ্গী এসপি ও দু’ট্রাক চালক এবং তাদের হত্যা করা হয়।

২৮ মার্চ একজন পাঞ্জাবী মেজরের অধীনে ক’জন বাঙ্গালী সৈন্য হুগলীপাড়ার সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর) চত্ত্ব্বরে পাহারা দিচ্ছিল। দ্বিতল ভবনে কামান পেতে মেজর বাঙ্গালীদের তৎপরতা ল করে ওয়ারলেসে খবর দেয়ার সময় বাঙ্গালী সেনারা তাকে হত্যা করে।

এ ঘটনা জানতে পেরে হানাদাররা হুগলীপাড়ার ছাত্র আব্দুল লতিফকে র্নিমমভাবে হত্যা করে রেল ইঞ্জিনের বয়লারে পুড়িয়ে মারে। ১ এপ্রিল সশস্ত্র বাহিনী ও স্থানীয় যুবকদল সন্ধ্যা থেকে শহরের চারিদিকে অবস্থান গ্রহন করে। মর্টার লাঞ্চার বসানোর হয় বৃত্তিপাড়ায়। হলদীবাড়ীতে একটি সশস্ত্র দল মোতায়েন করা হয়। গ্রামাঞ্চলের লোকজন মাঠে, দা, বল্লম নিয়ে শহরের বাইরে সমেবেত হতে লাগল। ভোর ৬ টায় তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। প্রচন্ড শব্দে প্রথম সেল নিক্ষিপ্ত হয় শহরের শোয়েব বিল্ডিং (বর্তমানে পৌরসভা) এর উপর এবং তা ভেঙ্গে যায়। এভাবে বেশ কয়েকটি সেল পার্বতীপুরের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানার পর অবাঙ্গালীদের গুলি বর্ষণ থেমে যায়।

বাঙ্গালীরা সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল ঢুকে যায় শহরে। ২ এপ্রিল বাঙ্গালীরা মুক্তিযোদ্ধাদের পার্বতীপুর আক্রমনের প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য পাক সেনারা ও তাদের সহচর অবাঙ্গালী বিহারী, পেশোয়ারী, ইরানী ও অন্যান্য উর্দুভাষী ব্যক্তিরা হিংস উন্মাত্ততার মেতে উঠে। তারা পার্বতীপুর শহরের ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায়। মেয়েদের উপর চালায় পাশবিক নির্যাতন।

পার্বতীপুরের সব চেয়ে মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ঘটায় ৮ এপ্রিল। এ দিন পার্বতীপুর শহরের অবাঙ্গালীদের নেতা বাচ্চা খানের নেতৃত্বে একটি সামরিক গাড়ি যায় খোলাহাটিতে এবং বিপরীত দিক থেকে আরও একটি দল খোলাহটি পৌছে।

দুইটি দলের পাক সেনারা বিকেল ৩ টার দিকে আক্রমন ও নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশুসহ প্রায় ৩শ’ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে ও কয়েক শ’ নারী বৃদ্ধ, শিশু আত্মরার্থে পালিয়ে যাবার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় এবং শ’ শ’ ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। পার্বতীপুরে পাক সেনাদের এ গণহত্যা ও নৃশংসতা হিটলারের নাৎসী বাহিনীকেও হার মানায়। ধর্ষিত হয় অসংখ্য মা-বোন। লুট হয় ব্যাপক ধনসম্পদ।

পাকসেনা, মিলিশিয়া, রাজকার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন নিপীড়ন দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। খিয়ারপাড়া গ্রামের ১৪ জন যুবককে এক সংগে ধরে এনে সারিবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। ভবানীপুর থেকে ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আঃ হাকিম কে ধরে এনে কয়লার ইঞ্জিনের বয়লারে নিপে করে পৈশাচিকভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।

এছাড়া হানাদার বাহিনী পার্বতীপুর-সৈয়দপুর রেল পথের ১নং লেবেল ক্রসিং এর পাশে শ’ শ’ লোকজনকে জবাই করে এবং ভোটগাছ এলাকার একটি কুপে গুলি করে লোকজনকে গণকবর দিয়েছিল। চন্ডিপুর ইউনিয়নের কালিকাবাড়ী ডাঙ্গা গ্রামে একটি কুপের মধ্যে কচুকাটার মত করে ফেলে দেয়।

১৩ ডিসেম্বর ভবানীপুর, হাবড়া, বেলাইচন্ডি, খোলাহাটি ও হরিরামপুর এলাকার পাকসেনা ক্যাম্প, রাজাকার ক্যাম্পগুলো মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেয়া শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পার্বতীপুর থেকে পালাতে থাকে। ১৪ ডিসেম্বর প্রথম ভারতীয় বিমান বাহিনী বোমা মেরে পার্বতীপুরে রেলওয়ে তেল ট্যাংকার ধ্বংস করে। মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনের মুখে পাকসেনা রাজাকার এবং অবাঙ্গালী সকল বাসিন্দা শেষ রাতে রেল যোগে পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুর পালিয়ে যায়।

পাকসেনার শেষ সামরিক গাড়িটি পালানোর পথে বেলাইচন্ডির অদুরে বান্নিঘাটে পেতে রাখা মাইন বিষ্ফোরনে উড়ে যায়। এতে একজন কর্ণেল, একজন মেজর ও একজন লেফটেনেন্ট নিহত হয়। ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযাদ্ধা ও শ’শ’ লোকজন পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করে এবং শোয়েব ভবন (বর্তমান পৌরসভা ভবন)সহ বড় বড় ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বিজয়য়োল্লাস শুরু করে। এভাবেই দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুব্ধ ও নানা ত্যাগ তীতিক্ষার পর ৭১এর আজকের এ দিনে পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত হয়।