খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬: এবার আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধার অবৈধ ব্যবহারকারী কূটনীতিক ও বিদেশি নাগরিকদের গাড়ি ধরছে শুল্ক গোয়েন্দা। সংস্থাটি ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল-ইউএনডিপির কর্মকর্তাদের ব্যবহার করা একটি গাড়ি জব্দ করেছে, আরেকটি জব্দের প্রক্রিয়া চলছে।
কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহারকারী আরও বেশকিছু কূটনীতিক ও বিদেশির গাড়ি দ্রুত জব্দ করা হবে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, শুল্ক ফাঁকি ও অবৈধভাবে ব্যবহার করা ৩৬টি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান গতকাল বলেন, আমরা কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার ও আইন ভঙ্গ করে শুল্কমুক্ত সুবিধার গাড়ি ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। সরকারের রাজস্ব সুরক্ষা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কূটনীতিক এবং বিদেশিসহ যেসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করছেন, তাদের ধরা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কূটনীতিকদেরও বেশকিছু গাড়ির ওপর নজরদারি চলছে। এদিকে কূটনৈতিক সুবিধায় শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে তা অপব্যবহারকারী আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশ কান্ট্রি অফিসের সিনিয়র স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট কিশোর কুমার সিংহকে গতকাল এক তলবিপত্র দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা।
সূত্র জানায় সংস্থাটির যুগ্ম কমিশনার মুহাম্মদ সফিউর রহমান স্বাক্ষরিত ওই পত্রে শুল্ক গোয়েন্দা বলেছে, বিগত ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউএনডিপিতে কর্মরত থাকাকালীন ২০১১ সালে কিশোর কুমার সিংহ তার পুরনো কাস্টমস পাসবুক (নম্বর-১০৫/১১) দিয়ে কূটনৈতিক সুবিধায় শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে ব্যবহার করেন। এরপর তিনি নিয়মানুযায়ী পাসবুকটি ফেরত দেননি এবং গাড়ির অবস্থান জানাননি। পরে আবার ২০১৪ সালেই তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলওতে যোগ দিয়ে কূটনৈতিক সুবিধার জন্য আরেকটি পাসবুক সংগ্রহ করেন। মানে তিনি দুই পাসবুক দিয়ে একটি গাড়ি ব্যবহার ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেছেন। এটা শুল্ক আইন পরিপন্থী এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ। তাই কাস্টমস পাসবুক ও শুল্কমুক্ত সুবিধার বিলাসবহুল গাড়িটি নিয়ে আগামী ২২ ডিসেম্বর কিশোর কুমার সিংহকে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত ২৯ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের আশিকুল হাসিব তারিকের বাড়ি থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল-ইউএনডিপিতে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক স্টিফেন প্রিসনারের কূটনৈতিক সুবিধার শুল্কমুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, কূটনৈতিক কোটার অপব্যবহার করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় মিতসুবিশি পাজেরো গাড়িটি আমদানি করেছেন। আবার তা পরবর্তীতে বিক্রি করে দিয়েছেন। গাড়িটির আনুমানিক বাজার মূল্য এক কোটি টাকা।
শুল্ক গোয়েন্দা জানিয়েছে, গাড়িটিতে হলুদ রেজিস্ট্রেশন প্লেট পাওয়া যায়, যা শুধু কূটনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তরা ব্যবহার করেন। গাড়িটি শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা হয়। শুল্কমুক্ত হিসেবে ছাড় করা গাড়ি বিক্রি না করার শর্ত পালন করা হয়নি। প্রিসনার অনুমতি না নিয়ে এবং শুল্ক পরিশোধ না করেই গাড়িটি হস্তান্তর করেছিলেন। এটা আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। এমনকি গাড়িটি বিক্রি করেই তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
এমন প্রেক্ষাপটে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. ইফতেখারুজ্জামান সম্প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশের ২৫টি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় নিয়োজিত কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা শুল্কমুক্ত কোটায় গাড়ি ব্যবহার করছেন। এর মাধ্যমে তারা দেশের শুল্ক আইন ভঙ্গ করেছেন। পাশাপাশি সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, উদ্বেগজনক তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবি আরকে অভিনন্দন। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বাংলাদেশের শুল্ক আইন ভঙ্গের ঘটনায় এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চার প্রকট অভাব। বাংলাদেশের শুল্ক আইন ভঙ্গ করার মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহের সাবেক কর্মকর্তারা জেনেভা কনভেনশনের স্বীকৃত রীতিনীতিও নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করেছেন।
প্রসঙ্গত, উন্নয়ন-সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন এমন ৩৯৫ জন বিদেশি নাগরিক চিহ্নিত করে তাদের একটি তালিকা করেছে এনবি আর। এই তালিকায় বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি, ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা ডিএফআইডি, জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকা, ইউনিসেফ ও ইউএনডিপির মতো ২৫ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা রয়েছেন। তারা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়ির অপব্যবহার করেছেন। তারা বাংলাদেশে অবস্থান শেষে গাড়ি ফেরত নেননি। এমন প্রায় ৪০০ দামি গাড়ির বেশির ভাগই স্থানীয় বাংলাদেশিদের কাছে বিক্রি করেছেন। এতে সরকার কয়েকশ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।
১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে কাজ করা ৩৯৫ জন বিদেশি নাগরিকের সন্ধান পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। প্রায় তিন মাস ধরে বিশেষ অনুসন্ধান শেষে এনবি আর জানতে পেরেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহারকারীদের তালিকায় বাংলাদেশে কর্মরত উন্নয়ন-সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও মুখ্য অর্থনীতিবিদসহ উচ্চপদস্থ সাবেক কর্মকর্তারা আছেন।
এনবি আরের তথ্য-উপাত্তে জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধার গাড়ির সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার করেছেন বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করতে আসা ৫৩ জন বিদেশি কর্মকর্তা মেয়াদ শেষে চলে গেছেন। তাদের গাড়িগুলোর খোঁজ নেই। অনেকে গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ সঞ্চয় কাঠুরিয়া ২০১৪ সালে ফিরে যাওয়ার সময় শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধার বিপরীতে ইস্যু করা পাশবই এনবি আরে জমা দেননি। ঢাকা কার্যালয়ের আরেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ সালমান জাইদিও একই কাণ্ড করেছেন। তিনি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়ি ব্যবহার করে চলে গেছেন। একইভাবে ইউএনডিপির ৪৪ জন ও জাইকার ৪১ জন কর্মকর্তা এই সুযোগের অপব্যবহার করেছেন।
অন্যদের মধ্যে ইউনিসেফের ২৩ জন, ডিএফআইডির ১৮ জন, খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ১৭ জন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১২ জন কর্মকর্তা আছেন। গাড়িগুলোর কোনো খোঁজ নেই। এমন প্রেক্ষাপটে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে কারণ দর্শাও নোটিস জারি করা শুরু করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। বাংলাদেশ প্রতিদিন