খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬: সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে। এখন চলছে ভোট গণনা। ফলাফল যাই হোক না কেন, মেনে নিতে বাধ্য সকলে। কারণ সন্ত্রাসের নগরীখ্যাত নারায়ণগঞ্জ এবারই প্রথম একটি নির্বাচনে কোন গ-গোলের খবর শোনা যায়নি। সব দল থেকেই বলা হয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, সব প্রার্থীই মেনে নেবেন এমন ঘোষণাও দিয়েছেন। বিশ দলীয় জোটের পক্ষ থেকেও নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা হয়েছে। সরকারী দলের পক্ষ থেকেও ফলাফল যাই হোক না কেন, মেনে নেওয়া হবে এমন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ভোর আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে নারায়ণগঞ্জের ১৭৪টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জের সদর আসনের এমপি আলোচিত শামীম ওসমান প্রকাশ্যেই নৌকায় ভোট দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। এছাড়া নির্বাচনে কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এমন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত হবে, এটি সকলের কাছে ছিল একটি বিস্ময়ের ব্যাপার।
আজ সারা বাংলাদেশ সহ বহির্বিশ্বেরও দৃষ্টি ছিল নারায়ণগঞ্জের দিকে। সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রে নারী-পুরুষের ব্যাপক ভিড় পরিলক্ষিত হলেও আস্তে আস্তে তা কমতে শুরু করে। দুপুরটা অনেকটা ফাঁকাই যায় বিভিন্ন কেন্দ্রে। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে জানা গিয়েছিল, ভোট পড়েছে ৫২ শতাংশ। কিন্তু সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, ভোট পড়েছে ৬৩ থেকে ৬৫ শতাংশ। ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬২ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৯ জন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত কোনও ধরনের কারচুপি বা অনিয়ম না হলে জনগণের মতামতকে মেনে নেবে বিএনপি। এ কথা জানিয়েছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কোনও ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াই, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন শান্তিপুর্ণ হয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন,জনগণ যে রায় দেবেন আওয়ামী লীগ তা মেনে নেবে। বৃহস্পতিবার বিকেলে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে নাসিক নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন।
মেয়রপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘নির্বাচন সত্যি সুষ্ঠু এবং ভীষণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে হচ্ছে। কেন্দ্রগুলোতেও আমার সঙ্গে আপনারা ছিলেন। কে জিতলো- হারলো সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচনের ফলাফলটা মেনে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। আমি সেটা করবো আগেও বলেছি। যদিও ভোটারদের ওপর আমার কনফিডেন্স আছে। এরচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে ২০১১ সালে আমরা জিতেছি।’
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, ‘ছোট-খাটো অভিযোগ পেয়েছি। তবে এখন তা বলবো না। ঝামেলার মধ্যে বলতে পারবো না, পরে বলবো।’
শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি ভালো। গতকাল আমি একটা জায়গায় ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। সে সময় তাদের সঙ্গে বসে কথাও বলেছি। কিন্তু একটি পত্রিকা রিপোর্ট করেছে আমি সেখানে মিটিং করেছি। আমার মনে হয় এ রিপোর্টে সাংবাদিকরা নিজেরাও লজ্জা পেয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘নৌকা স্বাধীনতা ও নিরীহ মানুষের শক্তি। আমার বিশ্বাস নৌকার পক্ষে বিজয় আসবে।’
নির্বাচনে সবচেয়ে অবাক বিষয় ছিল সাধারণ ভোটারদের উপস্থিতি কম। কেন্দ্রে কোন গ-গোল ছিল না। তবে কেন নির্বাচন কমিশনারের তথ্য অনুযায়ী ৩৫% ভোটাররা তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকল? সে ৩৫% ভোটার কারা? কি তাদের পরিচয়? তারা কি শুধু সাধারণ ভোটার ছিল, নাকি বিশ দলীয় জোটের পক্ষের মূল শক্তি ছিল, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ঐ ৩৫% ভোটারের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন এক নতুন মাত্রা যোগ হল। সেই মাত্রায় যদি হাঁটতে থাকে বর্তমান সরকারি দল তবে তা বিরোধী দলের জন্য মোকাবেলা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। রাজনীতির খেলায় বারবার ২০ দলীয় জোট আওয়ামী লীগের ছকে পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে।
সর্বশেষ মহামান্য রাষ্ট্রপতির ডাক সংলাপে বিএনপি সহ ২০ দলীয় জোটের আরেকটি দল এলডিপি সাক্ষাৎ করে এসেছেন। সেখানেও বিএনপি খুবই আশাবাদী। গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নির্বাসনে। নাসিক নির্বাচনের আগে ইতিপূর্বে সংগঠিত কোন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। ভোটকেন্দ্রে কুকুর ও গরুকেও দেখা গেছে। ভোটের দিন মানুষ হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে বহু। যদিও সেইসব অধিকাংশ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করা হয়নি। বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি’র পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করে অধিকাংশ জায়গায় বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও নির্বাচিত মেয়র বেশি সময় ধরে কারাগারে ও মামলা-হামলায় নির্যাতিত হয়েছেন। উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন নির্বাচনে ব্যাপক গন্ড-গোলের খবর পত্রিকা পাতা জুড়ে বের হয়েছে। ঠিক সেখানে সেই সরকারের আমলেই এমন নিরব নিরপেক্ষ নির্বাচন কোন কি প্রশ্ন রাখে না? সাধু সাবধান। যাই ঘটুক না কেন, গণতন্ত্রহীন দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য কোন পাতা ফাঁদে পা না রেখে তাদের কৌশলকে নতুন কৌশল দিয়ে পরাজিত করার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সবার দৃষ্টি এখনো নারায়ণগঞ্জের দিকে। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের ফলাফল আগামী দিনের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করবে।