খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬: আজ কুমিল্লার লাকসামের বিশ্বের প্রথম নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধূরানীর ১৮২তম জন্ম দিবসটি নিরবে-নিঃস্তব্দে কেটে যাচ্ছে। জমিদার প্রথম নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীকে এখন আর কেউ স্মরন করে না। দীর্ঘ ১৮১ বছর পার হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখনো মিলেনি তার ভাগ্যে। তার রেখে যাওয়া বহু স্থাপনা ও বহুস্মৃতি বিলীন হওয়ার পথে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যবাহী ‘‘কত লাকসাম কত বাতি’’ খ্যাত এ অঞ্চল কুমিল্লা জেলার প্রতœতাত্তি^ক নিদর্শন যেমন মোগল ঐহিহাসিক যুগের গৌরবের কথা জানান দেয়, তেমনি তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের এই মহীয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা লাকসামের ঐতিহ্যের কথা কয় নিজস্ব স্বকীয়তায়। একসময় ওই জমিদার বাড়ীতে খাঁন বাহাদুর শাহের রাজত্বকালে ২ কিলোমিটার অথ্যার্ৎ পশ্চিমগাঁও সামনের পুলের মাথা থেকে ওই রাজবাড়ী পর্যšত পায়ে জুতা, হাতে ছাতি-লাঠি নিয়ে কোন লোক যেতে পারতো না যা ছিল শা¯িতযোগ্য অপরাধ। জমিদারের পাইক-পেয়াদারা ছিল এ ব্যাপারে সর্বদা সচেতন। অথচ অযতœ অবহেলায় আজ প্রভাবশালী ওই জমিদার বাড়ীটি রুগ্ন হয়ে ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ওই পরিবারের আলোচিত নারী নবাব ফয়েজুন্নেছার এখন আর জন্ম-মৃত্যু দিবসটিও পালন করা হয় না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার তৎকালীন হোমনাবাদ পরগনা লাকসামের পশ্চিমগাঁও গ্রামে নবাব ফয়জুন্নেছা জন্ম গ্রহণ করেন। জমিদার আহম্মদ আলী চৌধুরী হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর পিতা। তৎকালীন হোমনাবাদের জমিদার আহম্মদ আলী চৌধুরী ও ভুলুয়ার জমিদার আসাদ চৌধুরী কন্যা আরফান্নেছা চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ কন্যা হলেন এ মহিয়ষী নারী ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। নবাব ফয়জুন্নেছার দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে সৈয়দা বদরুন্নেছা চৌধুরানীকে নিজ গ্রাম পশ্চিমগাঁওয়ে এবং অপর মেয়ে সৈয়দা আসাদুন্নেছা চৌরানীকে বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার জমিদার বাড়ীতে বিয়ে দেয়। পরিবার-পরিজন ও এলাকার লোকজন তাঁকে ফয়জুন বেগম বলে ডাকতেন।
স্থানীয় লোকজন জানায়, জমিদারী প্রথা বিলোপের পর এ নবাব বাড়ীর জমিদারের একসময় ওদের অধীনে ১৪টি মৌজায় বহু সম্পদ ও স্থাপনা ছিল বংশধররা এখন আর সেগুলোর কি অবস্থা কারো যেন খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন নাই। নবাব বাড়ীর স্মৃতি রক্ষায় কারো যেন কোন মাথা ব্যাথা নেই। স্থাপনাগুলোর পুরনো ভবনগুলো ‘‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত’’ দাঁড়িয়ে আছে। দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক এ নবাব বাড়ী দেখার জন্য প্রতিনিয়ত এখানে আসছেন। এমনকি দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতিমান লোকজন এ নবাব বাড়ী দেখতে এসে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় এ নবাব বাড়ীর জমিদারদের রাজত্বের পতন ঘটে প্রায় পৌনে দু’শ বছর আগে। কিন্তু এখনো রয়ে গেছে তাদের স্মৃতি চিহ্নক। ওদের বংশধরদের কেউ কেউ এখনো জীবিত। তাদের চালচলন-কর্মতৎপরতায় জানান দেয় জমিদারী সামাজ্যের রাজত্বকালের বিভিন্ন ইতিহাস। স্থাপনাগুলো স্মরন করিয়ে দেয় সেই জমিদারী আমলের রাজকীয় আবহ। যেই ভবনে বসবাস ও রাজ্য চালাতেন এ নবাব বাড়ী জমিদাররা সেই ভবনগুলো আজ রুগ্ন। ভেঙ্গে যাচ্ছে ভবনগুলোর বেশির ভাগ অংশ। নানান কারুকাজ ঢাকা পরে জন্মেছে পরগাছা আর শেওলার আবরন। বিভিন্ন স্থাপনায় গাছ-গাছড়ায় বিরাজ করছে ভূতড়ে পরিস্থিতি। চর্তুপাশের দেয়ালগুলো ভেঙ্গে গেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ৬ষ্ঠ বংশধর আহম্মদ আলী চৌধুরীর পিতা জমিদার নন্দিনী আরফান্নেছা মাতার তৃতীয় সন্তান এ ফয়জুন্নেছা। বড় দুই ভাই ইয়াকুব আলী চৌধুরী ও ইউছুফ আলী চৌধুরী এবং ছোট বোন লতিফান্নেছা চৌধুরী রানী। প্রাচুর্যেই জন্মে ছিলেন জমিদার তনয়া ফয়জুন্নেছা। বাল্যকালেই ১৮৪৪ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে আকালেই তিনি পিতৃহারা হলেন। তখন তিনি ১০ বছরের বালিকা মাত্র। ১৮৪৯ সালের শেষ দিকে অনেক নাটকীয় ও কৌশলী শর্তের বেড়াজালে অবশেষে ফয়জুন্নেছার বিয়ে সম্পন্ন হলো দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে তরুন প্রেমিক জমিদার গাজী চৌধুরীর সাথে। এরমধ্যে দুটি কন্যা সন্তান জন্ম নিল আরশাদুন্নেছা ও বদরুন্নেছা। ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর ফয়জুন্নেছা জমিদারীর দায়িত্ব তুলে নিয়ে কর্মতৎপরতার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলেন একজন সুদক্ষ, প্রজাহিতৈষী, শিক্ষানুরাগী, তেজস্বী ও বিচক্ষণ শাসক হিসাবে। তিনি পিতা-মাতার শোককে হাতিয়ার করেই দীর্ঘ ২১ বছর জমিদারী শাসনে হয়ে উঠেন জীব সংগ্রামের এক অনন্যা মহিয়ষী নারী।
সূত্র আরো জানায়, জমিদার ফয়জুন্নেছার সমগ্রজীবন ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলার মধ্যে। জমিদারী পরিচালনা ছাড়াও তাঁর দুটি প্রধান সাধনা ছিল আল্লাহর ইবাদত এবং সাহিত্য সাধনা। নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর জমিদারীর ১৪টি মৌজা ছাড়াও দেশে-বিদেশে ১৪টি প্রাথমিক মক্তব, প্রাথমিক বিদ্যালয়, দ্বীনিয়াত শিক্ষা, হাইস্কুল, বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল, দিঘী-পুকুর, মসজিদ, মুসাফিরখানা, পুল-ব্রিজ, পত্র-পত্রিকায় পৃষ্ঠপোষকতা, কবি সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ, ফয়জুন পাঠাগার, রূপজালাল গ্রন্থ রচনাসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করে গেছেন তিনি। এছাড়া ১৮৯৪-৯৫ সালে মক্কাশরিফে হজ্বব্রত পালন করতে গিয়ে ওই দেশের বাদশা আব্বাসিয় খলিফা হারুনুরু রশিদের স্ত্রী নামে যোবায়দা নহর পুনঃখনন এবং একটি মুসাফিরখানা রোবাত স্থাপন করেন। ১৮৯১ সালের ১৮ জুন তার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি জনকল্যানে ওয়াকফ করে দেন। তিনি তাঁর ১৪ পরগনায় প্রায় সময়ই পালকীতে চড়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড তদারকিতে যেতেন।
তৎকালীন ভিক্টোরিয়া মহারানী বিশ্বের একজন মুসলিম নারী জমিদারের মহানুভবতা ও দানশীলতায় মুদ্ধ হয়ে রানী ফয়জুন্নেছাকে বেগম উপাধিতে ভূষিত করলে তিনি সম্মানের সাথে প্রত্যাখান করেন। মহিলা জমিদার হিসাবে এমনিতেই তিনি বেগম বলে পরিচিত। রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ দরবারে পুনরায় পরামর্শ করে ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীকে নবাব উপাধিকে ভুষিত করার সিদ্ধান্ত নেন যা ১৮৮৯ খ্রিঃ সেই খেতাব প্রদান অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান কুমিল্লার চর্থাস্থ সৈয়দ বাড়ীর মাঠে। ১৯৯৬ সালে একুশে পদক ছাড়াও মিলেছে তার ভাগ্যে বিভিন্ন নারী বিষয়ক খেতাব তার জমিদারীর শাসনামলে হাসি কান্না দুঃখ বেদনায় ভরপুর তার সার্বিক জীবনে কাহিনী নিয়ে রূপক কাব্যগ্রন্থ রূপজালাল বইটি ১৮৭৬ খ্রিঃ প্রকাশ করা ছাড়াও তার কর্মজীবনের উপর বিভিন্ন লেখক ও গবেষক প্রায় ২০টির মত বই রচনা করেছেন। অবশেষে ১৯০৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর এ মহিয়ষী প্রথম রানী নবাব ফয়জুন্নেছা চির নিদ্রায় শায়িত হন তারই নির্মিত নবাব বাড়ি জামে মসজিদের পাশে।