খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬: : কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলের ৫টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সরকারী নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র গড়ে উঠা প্রায় অর্ধশতাধিক ইটভাটা গিলে খাচ্ছে কয়েক হাজার একর আবাদি কৃষি জমি। এছাড়া ওইসব ইট-ভাটার কালো ধোয়া ও বায়ু দূষনে এ অঞ্চলের পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। অথচ পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও রাজস্ব বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরের প্রত্যায়নপত্র এবং ছাড়পত্র দেয়ার মত কোন ইটভাটাই খুঁজে পাচ্ছে না ওই সকল বিভাগের কর্মকর্তারা। বরং অবৈধ ভাবে উৎপাদন হচ্ছে প্রতিনিয়ত নির্মাণ সামগ্রীর প্রধান কাঁচামাল ইট।
জানা যায়, লাকসামে ৮টি ও মনোহরগঞ্জে ৬টি, নাঙ্গলকোটে ১৯টি, বরুড়ায় ৯টি ও সদর দক্ষিনে ১১টি ইটভাটায় সরকারী বিধি-বিধান না মেনে পুরোদমে ইট তৈরী করছেন ভাটার মালিককরা। ২/১টি ছাড়া শিংহভাগ ইটভাটায় প্রতিবছর গ্যাস ও কয়লা ব্যাতিত কাঠেরগুড়া, মাটিয়া তৈল ও কাঠ পড়ানো হচ্ছে হাজার হাজার টন। সবকটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে এলাকার আবাদি কৃষি জমিতে। বর্তমান মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে গ্রাম থেকে শহরে নগরায়ন ও শিল্পায়নের লক্ষে নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে ইটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর রহস্যজনক নিরবতার সুযোগে কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে যত্রযত্র ইটের ভাটা। ওই ইটভাটাগুলো পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্মত প্রযুক্তিতে নির্মিত হচ্ছে না।
এদিকে ইট ভাটা মালিকরা স্থানীয় ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারছেনা এলাকার সাধারন মানুষ। ইটভাটা স্থাপনে পরিবেশ,বনবিভাগ ও কৃষি বিভাগের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী হাইব্রিড হফম্যান, জিগ-জ্যাগ, ভার্টিক্যাল শ্যাফট কিলন কিংবা বিএসটিআই পরীক্ষিত নতুন প্রযুক্তির এলাকায় পরিবেশ বান্ধবসহ সরকারী অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রয়োজনীয় অনুমতি প্রয়োজন। এছাড়া জিগ-জ্যাগ প্রদ্ধতিতে রূপাšতরিত ইট ভাটা গুলোকে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ওই আইনে ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যšত সময় সীমা বেঁেধ দেয়া হলেও বিদ্যমান আইনে কারাদন্ড কিংবা অর্থদণ্ড হওয়ার কোন নজির নেই। অথচ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর বাৎসরিক হালনাগাদ ছাড়পত্র কিংবা প্রত্যায়নপত্র না নিয়েই ইটভাটাগুলো বিনা বাধায় অবাধে ইট উৎপাদন করে চলেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার দক্ষিনাঞ্চল ৫টি উপজেলায় সরকারী নীতিমালা অমান্য করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই গায়ের জোরে নিজেদের খেয়ালখুশি মত ইটভাটা স্থাপন করে ইট পুড়িয়ে এ অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছে ভাটার মালিকরা। ইট ভাটার বিরুদ্ধে বিভাগীয় পরিবেশ দপ্তর কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যে ২/১টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলেও স্থানীয় প্রশাসন কোন ভূমিকা রাখতে দেখা যায় নি। অথচ পরিবেশ সংরক্ষন আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর ১২ ও ৪ এর ২/৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আবাদী কৃষি জমি, পরিবেশ সংকটাপন্ন ও জনবসতি এলাকা এবং আশেপাশে ইটভাটা স্থাপন করা দন্ডনীয় অপরাধ। আবার ২/১টি ছাড়া অনেকের প্রয়োজণীয় কাগজপত্র ও ইটতৈরীর উন্নত ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসহ পরীক্ষিত কোন সরঞ্জাম নেই বললেই চলে। গত বছর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ দপ্তর এ অঞ্চলের বেশকটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে অর্থদন্ড ও মামলা রুজু করলেও ওইসব অসাধু ইটভাটা মালিকদের অবৈধ বানিজ্য দমাতে পারেনি।
জেলা পরিবেশ ও স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্যমতে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ এলাকা থেকে কমপক্ষে ১ কিঃ মিঃ ও এলজিইডি নির্মিত সড়কের আধা কিঃ মিটারের মধ্যে কোন ইটভাটা হতে পারবে না। বিশেষ করে নিষিদ্ধ এলাকায় হিসাবে আবাসিক, সংরক্ষিত ও বানিজ্যিক এলাকা, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, কৃষি আবাদী জমি, বন ও বাগানকে বুঝানো হয়েছে। এছাড়া বিদ্যমান আইনে আবাসিক ও কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করলে ৫ বছর কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা অর্থ দন্ডে আর নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় না রাখলে ১ বছর কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা অর্থ দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে এসব আইন, ধারা-উপধারা শুধু মাত্র কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ।
এ বিষয়ে মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোট উপজেলার একাধিক ইটভাটা মালিক দম্ভোক্তির সুরে জানায়, আমরা নিয়ম মাফিক ভাবে এবং স্থানীয় প্রশাসনসহ বিশেষ বিশেষ মহলকে ম্যানেজ করে ইট-ভাটা চালাচ্ছি। এছাড়া বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিবসগুলোতে স্থানীয় প্রশাসনকে মোটাঅংকের টাকা দিতে হয়। আপনারা সাংবাদিক সবকিছুই বুঝেন এদেশে টাকা হলে সবকিছু সম্ভব। পত্রিকায় লেখালেখি করলে কিছুই হবেনা। নীচতলা থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উপর তলা পর্যন্ত আমাদের ঠিকরাখা আছে।
এ ব্যাপারে জেলা ও বিভাগীয় সংশ্লিষ্ট কোন সংস্থা স্থানীয় সাংবাদিকদের তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও জেলা দক্ষিনাঞ্চলের স্থানীয় প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, সরকারি নিয়ম-নীতি অমাণ্য করে কোন ইটভাটার মালিক যদি লাইসেন্স বা প্রত্যয়ন পত্র বিহীন কিংবা আনুসাঙ্গিক কাগজপত্র ছাড়া ভাটার কার্যক্রম করেন সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নতুন আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে উপজেলা বন ও কৃষি বিভাগের দায়িত্ব অতি মূখ্য হলেও দপ্তর কর্মকর্তাদের রহস্যজনক নিরব ভূমিকায় এলাকার জনমনে নানাহ কানাঘুষা হচ্ছে।
স্থানীয় প্রশাসনগুলোর আরেকটি সূত্র জানায়, গ্যাস-কয়লা ও পরীক্ষিত সরঞ্জাম ছাড়া ইটভাটায় কাঠ পড়ানোর ফলে পরিবেশের ক্ষতিকর ও আবাদি কৃষিজমি বিলুপ্তের প্রভাব ফেলতে পারে বিধায় বিগত সরকার নীতিগত ভাবে সাবেক সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা ছাড়পত্র প্রদান বন্ধ করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে এক পরিপত্র জারি করে। আবার ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্বের সনাতন পদ্ধতির ইটভাটার কোন প্রত্যায়ন পত্র ও ছাড়পত্র নবায়ন করা হবে না বলে সংশোধিত আরেকটি পরিপত্র জারি করেন। এমনকি একটি সময়ের মধ্যে পূবের্র সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাকে পরিবেশ বান্ধব কমপ্রেসড ব্লক ইট বা অনুরূপ কোন ডিজিটাল পদ্ধতিতে ইটভাটাকে রূপান্তর করার নির্দেশনা দিয়েছেন অথচ কোন ভাটার মালিক আইন-কানুন মানছে না।
জেলা পবিবেশ অধিদপ্তরের জনৈক কর্মকর্তা জানায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সরকারী বিধি অনুসারে নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিবেশগত ও আইনগত সংশ্লিষ্ট বিভাগের ছাড়পত্র এবং প্রত্যায়নপত্র ব্যাতিরেকে কেউ কোন ইটভাটা স্থাপন কিংবা পরিচালনা করতে পারবে না। এমনকি কোন ইটভাটায় বর্তমান আইনে কাঠ পড়ানো কোন বিধান নেই। এরপরও যদি কোন ইটভাটা অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের বিরুদ্ধে আইন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিছুদিন আগে এ অঞ্চলে বিভাগীয় পরিবেশ কর্তৃপক্ষ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বেশ ক’টি ইটভাটা মালিককে জরিমানা ও এদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে এ অঞ্চলের সবকটি ইটভাটা পরিদর্শন করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।