খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০১৭: জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের ওপর শুনানির জন্য ২৬ জানুয়ারি পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
এর আগে খালেদা জিয়ার পক্ষে সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এ দিন ধার্য করেন।
খালেদা জিয়া উপস্থিত হওয়ার আগে সকাল সাড়ে ১০টায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শুরু করেন। পরে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে জেরা করেন আইনজীবী আবদুর রেজাক খান।
জেরাকালে আইনজীবী আবদুর রেজাপক খান জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কত তারিখে তদন্ত কর্মকতা হিসেবে দায়িত্ব নেন?’ জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘২৯ আগস্ট ২০০৮ সালে এ মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করি। এরপর আইনজীবীর প্রশ্ন, ‘তদন্তকালে আপনি কি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কোনো তথ্য নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ করেছি।’
রেজাক খান আরো প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কী কী তথ্য নিয়েছেন? আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করি। কিছু ব্যক্তির কথা রেকর্ড গ্রহণ করি। অনুসন্ধান করে কাগজপত্র পর্যালোচনা করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আংশিক প্রতিবেদন দাখিল করি।’
আইনজীবী তদন্ত কর্মকর্তাকে আরো জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি ওই সময় কী পদে ছিলেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘তখন আমি দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) উপসহকারী পরিচালক পদে ছিলাম।’
আইনজীবী বলেন, ‘কারাগারে থাকাকালীন অবস্থায় আপনি বেগম খালেদা জিয়াকে কি জিজ্ঞেস করেছেন?’ জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি।’
আইনজীবী বলেন, ‘আপনি যে প্রতিবেদন দিয়েছেন তাতে বলেছেন, জিয়া মেমোরিয়াল ও অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বাগেরহাট শাখায় প্রাথমিক তদন্তে কোনো অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের তথ্য পাওয়া যায়নি।’ জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘জি হ্যাঁ।’
আবদুর রেজাক খান আরো বলেন, ‘অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার টাকা কোথা থেকে আস্তে কোন অ্যাকাউন্ট থেকে আসে আপনার কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য আছে কি?’ তদন্ত কর্মকতা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’
আইনজীবী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আপনাকে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।’ তদন্ত কর্মকতা বলেন, ‘না দেওয়া হয়নি।’
আইনজীবী বলেন, ‘এরপর আপনি কি কোনো ডকুমেন্ট জব্দ করেছেন?’ জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘তখন আমি করিনি।’ আইনজীবী বলেন, ‘আপনি করেননি নাকি ক্ষমতা ছিল না। অর্থাৎ দুদক আইনে সে ক্ষমতা ছিল না।’
জবাবে তদন্ত কর্মকতা বলেন, ‘না, করিনি।’ তখন আইনজীবী বলেন, ‘আপনার ক্ষমতা না থাকায় আপনি করেননি।’
এ সময় আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা হওয়ার পর আপনাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।’ জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘সে কারণে নয়।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী বলেন, ‘গত বছর ১৬ জন সাবেক জেলা জজ হাইকোর্টে আবেদন করেছেন আইনজীবী হিসেবে আদালতে প্র্যাকটিস করার জন্য। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তাঁদের অনুমতি দেননি।’
এ সময় বিচারক আবু আহমেদ জমাদার আইনজীবীকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে এটার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি এখন শুধু মৃত্যুর প্রহর গুনছি এবং সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
এ সময় ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আপনাকে তো হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং আমি তো সামনে শুধু মৃত্যুকে দেখছি এবং সেটার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
এ পর্যায়ে আইনজীবী রেজাক খান আবার প্রশ্ন করেন, ‘তারেক রহমানকে আপনি যখন জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তখন তিনি কী বলেছেন?’ জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘তারেক রহমান বলেছেন, কুয়েতের আমিরের টাকায় জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট পরিচালিত হয়।’ এরপর আদালত ১২টা ১০ মিনিটে ২০ মিনিটের জন্য বিরতি দেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় আবার শুনানি শুরু হলে তখন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার জেরা মুলতবি করেন। শুরু হয় দুই মামলার আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে শুনানি।’
এ সময় ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘যেহেতু আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়ে হাইকোর্টে একটি আবেদন বিচারাধীন রয়েছে এবং এটি একটি বেঞ্চে কার্যতালিকায় শীর্ষে আছে, সে জন্য বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সময় দেওয়া হোক।’
পরে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘মামলাটি এখন আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। আসামিপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাননি। তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের কার্যক্রম চালানো হোক।
উভয় পক্ষে শুনানি শেষে আদালত প্রথমে ১৯ জানুয়ারি মামলার শুনানির দিন ঠিক করেন।
কিন্তু খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতকে বলেন, আগামী ১৯ তারিখ জিয়াউর রহমানের জন্মদিন। তাই শুনানির জন্য ওই দিন বাদে অন্য যেকোনো দিন ধার্য করা হোক। আদালত তারপরও ১৯ জানুয়ারি শুনানির কথা বলেন। একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নাল আবেদীন আদালতকে বলেন,১৯ জানুয়ারি বাদে যেকোনো দিন শুনানির তারিখ ধার্য করলে তাঁরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন। পরে আদালত ২৬ জানুয়ারি মামলার শুনানির তারিখ ধার্য করেন।
এদিকে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার বিচারকাজও একই আদালতে চলছে। এই মামলায় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুদকের তৎকালীন পরিচালক নূর আহমেদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাঁকে জেরা শুরু করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা
এর আগে এ দুটি মামলায় হাজিরা দিতে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে রাজধানীর গুলশানের বাসা থেকে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতের উদ্দেশে রওনা হন খালেদা জিয়া। বেলা ১১টার কিছু আগে তিনি আদালতে পৌঁছান।
দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুর রেজাক খান, জয়নাল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট রাশেদা আলম। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল।
শুনানির শুরুতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদকে জেরা করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এর পর দুই মামলায় খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের ওপর শুনানি শুরু হয়।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।
জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় দুর্নীতির অভিযোগে এ মামলা করেছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ।
ওই মামলার অপর আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বি আইডব্লিউটিএ) নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
অন্যদিকে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় আরো একটি মামলা করে দুদক।
মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।