খােলা বাজার২৪, শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি ২০১৭: অথচ ‘সিনেমাটিক’ ব্যাপার স্যাপার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। কখনো ছয় বলে ছয় ছক্কা মারেন, কখনো ক্যাচ ফেলে দলের পরাজয়ের কারণ হন। দলকে জেতান দুই দুটি বিশ্বকাপ। ফুসফুসে ক্যান্সার নিয়ে ওয়ানডে বিশ^কাপে এক আসরে সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করেছেন।
ক্যান্সারের সাথে লড়েছেন, ফিরেছেন এবং ছিটকে গেছেন পারফরম করতে না পেরে। ধরেই নেওয়া হয়েছিলো তার চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্য দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু লোকটা হাল ছাড়ার নয়। তিন বছর পর আবার ফিরে এলেন ওয়ানডে ক্রিকেটে। ফিরে মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচেই দুনিয়াকে বলে দিলেন – তিনি সব সিনেমার সেরা সিনেমা, তিনি সব নাটকীয়তার সেরা নাটক। হ্যা, কামব্যক কিং যুবরাজ সিং!
২০১৩ সালের পর গত চার বছর আর ওয়ানডে ক্রিকেটে সুযোগ মেলেনি। মাঠের বাইরে অনেক গুঞ্জন তৈরী করে ‘বিরাট কোহলির কল্যানে’ দলে ফিরেছেন এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে। প্রথম ম্যাচে মাত্র ১৫ রান করে কোহলিকে একটু বিপাকেই ফেলেছিলেন। গতকাল কটকে কোহলি নিশ্চয়ই উৎসব করেছেন।
কোহলি এবং নস্টালজিক ভারত সমর্থকদের মাতিয়ে গতকাল কটকে ১২৭ বলে ক্যারিয়ার সেরা ১৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন। সেই সাথে নাটকীয়তার চূড়ান্ত হিসেবে পুরোনো বন্ধু এবং ‘বর্তমান শত্রু’ সেই মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথে আবারও ২৫৬ রানের এক জুটি করেছেন!
যোগরাজ সিংয়ের পূত্র যুবরাজের জীবনের হেন কোনো অধ্যায় নেই, যেখানে নাটক নেই। যোগরাজ সিং লোকটাকে চিনেছেন তো? হ্যা, মিলখা সিংয়ের কোচ; সিনেমায়!
মূলত লোকে অভিনেতা হিসেবেই চেনে। তবে ভারতের হয়ে একটি টেস্ট ও ৬টি ওয়ানডে খেলেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় ছিলেন। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারার যে আক্ষেপ, সেখান থেকেই ছেলে যুবরাজকে ক্রিকেটার বানাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
বাবার চাওয়াই শুধু ক্রিকেটার বানালো যুবরাজকে। নইলে কতো কী যে হতে চেয়েছিলেন। ছোটবেলায় টেনিস আর রোলার স্কেটিংটাই টানতো বেশী। রোলার স্কেটিংয়ে সর্বভারতীয় যুব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। সেই মেডেল নিয়ে বাসায় ফেরার পর যোগরাজ ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন – ক্রিকেটার হতে হবে!
১১ বছর বয়সে পাঞ্জাব অনুর্ধ্ব-১২ দলের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু। আর নিজেকে চেনালেন ২০০০ সালের যুব বিশ^কাপে। ভারতকে টূর্নামেন্ট জেতানোর পথে টূর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন। ক্যারিয়ারে যুব ও সিনিয়র পর্যায়ে ভারতকে তিনটি বিশ্বকাপ শিরোপা জেতানোর পথে সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন!
যুব বিশ^কাপের ওই অসামান্য পারফরম্যান্সে সে বছরই কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত নক আউট বিশ^কাপের দলে ডাক পেলেন। নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, ব্রেট লিদের পিটিয়ে ৮০ বলে ম্যাচ জেতানো ৮৪ রান এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ!
এরপর থেকে ভারতের কিছু একটা জয় মানেই যুবরাজের অবদান, এটা একটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হলো। তবে ২০০২ থেকে ২০০৫ অবদি ফর্মটা ধারাবাহিক ছিলো না। ২০০৬ সালের শেষ দিকে সেটা বাজে অবস্থায় পৌছায়।
২০০৭ সালে ফর্মের চূড়ান্ত বাজে অবস্থা থেকে কোনোক্রমে দলে টেকসই হওয়ার পরই ধোনির সহঅধিনায়ক হয়েছিলেন। সে বছরই প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপটা জিতে এনে দেন ভারতকে। পরে কয়েকটা বছর উত্থান-পতন; এর মধ্যে উত্থানই বেশী।
২০১১ বিশ^কাপের আগে আগে মাঝে মাঝেই বুকে ব্যাথা ও বমিতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। সাথে ছিলো শ্বাসকষ্ট ও নাক দিয়ে রক্ত পড়া। কাউকে বলেননি। এই অবস্থায় বিশ্বকাপে ৩৬২ রান করলেন, ১৫ উইকেট নিলেন; যা যে কোনো বিশ্বকাপ আসরের সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের পথে চারটি ম্যান অব দ্য ম্যাচ ও টূর্নামেন্ট সেরার পুরষ্কার। এই আনন্দ মিলাতে না মিলাতে শরীরের পরীক্ষা করে জানা গেলো বাম ফুসফুসে ক্যান্সার!
চললো চিকিৎসা। কেমোথেরাপি নিয়ে ফিরলেন ক্রিকেটে। তবে ২০১২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপে ভারতের বিদায়ের আগে অবধি তিনিই হয়ে উঠেছিলেন সেরা তারকা। কিন্তু শেষ অবধি ২০১৩ সালে এসে সব ফরম্যাটে নিজেকে এতোটা হারিয়ে ফেলেন এবং একসময়ের ঘনিষ্ঠতম মানুষ ধোনির এতো আস্থাহীন হন যে, দলে আর জায়গাই হয়নি।
অবশেষে ভাগ্যের চাকা ঘুরলো। ভক্ত বিরাট কোহলি অধিনায়ক হলেন। আর প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই নির্বাচকদের বললেন, যুবরাজকে দলে চাই। এ নিয়ে অনেক কথাও হলো। স্বভাবতই তিলকে তাল করা মিডিয়া ‘কোহলি বনাম ধোনি’ লড়াই খুজে পেলো এখানে। সেই লড়াইয়ে কোহলি হেরে গেছেন বলে মনে হচ্ছিলো। অন্তত প্রথম ম্যাচে যুবরাজ ব্যর্থ হওয়ার পর ঢোল বেজে উঠেছিলো সংবাদ মাধ্যমে।
কিন্তু যে লোককে ক্যান্সার কাবু করতে পারে না, বোলাররা কাবু করতে পারে না; তাকে মিডিয়ার ঢোলের বাড়ি থামাবে কী করে! যুবরাজ ফিরে এলেন এবং কটকে ২১টি চার ও ৩টি ছক্কা মেরে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি তরুন অধিনায়কের মান রাখতে এসেছেন। মজাটা হলো, সেই ধোনির সাথেই জুটি হলো।
ভারতকে গত দশকে একটার পর একটা রোমাঞ্চ উপহার দেওয়া তাদের আধুনিক ক্রিকেটের সেরা জুটি ধোনি-যুবরাজ। চার, পাচ ও ছয়েই দু জন ব্যাট করতেন; ফলে একসাথে ৬৪ ম্যাচে ৫৩.৫২ গড়ে ৩০৫১ রান করে ফেলেছেন দু জন। ১০টি সেঞ্চুরি জুটি আছে তাদের। কিন্তু জুটির সেরা রানটা করার জন্য গতকালকের দিনটাই বেছে নিলেন।
তাজ্জব ব্যাপার। যুবরাজ সিংয়ের প্রত্যাবর্তন নিয়ে এতো বড় লেখা লিখে ফেললাম, সেখানে শিরোনামের কোনো নামগন্ধও নেই!
কেনো বললাম, যে যুবরাজ মাশরাফির বন্ধু?
মাশরাফির সাথে যুবরাজের বন্ধুত্ব সেই বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সময় থেকে। আজও অটুট আছে বন্ধুত্ব। আজও দেখা হলে কিংবা ফোনে মেতে ওঠেন তারা আড্ডায়। এই যুবরাজের আগ্রহে মাশরাফিকে নিয়ে সেবারের আইপিএলে কাড়াকাড়ি করেছিলো তার দল।
কিন্তু আমি প্রায়শ ঠিক বুঝতে পারতাম না, যুবরাজ কেনো মাশরাফির সবচেয়ে ভালো বন্ধু? মটর সাইকেল ছোটানো ছাড়া দু জনের তো কোনো মিল নেই। আজ যুবরাজের ইনিংসটা দেখতে দেখতেই হঠাৎ মিলটা দেখে ফেললাম। মাশরাফি আর যুবরাজের এক অন্তহীন মিলের নাম লড়াই। তারা হারতে জানেন না।
২০১১ সালে ঠিক আজকের দিনে বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়েছিলেন মাশরাফি; ফিরে এসে পরের বিশ্বকাপেই দলকে ইতিহাসের পথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মাশরাফি ১১ বার অস্ত্রপচারের টেবিল থেকে ফিরে এসেও দেশের সেরা বোলার।
ইনজুরি কিংবা ম্যানেজমেন্ট কেউ থামাতে পারে না তাদের। এই জন্যই তারা বন্ধু। এই যুবরাজই মাশরাফির বন্ধু।