খােলা বাজার২৪, সোমবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭: প্রাইভেট প্রাকটিসের সুযোগ নেই, আছে ঝুঁকি। এর বাইরে বিভিন্ন মামলায় হাজিরা দিতে সারাদেশে যেতে হয়। এর জন্য সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায় না কোনো টিএ-ডিএ। আর এসব কাজের জন্য প্রণোদনার কোনো ব্যবস্থা নেই, বিশেষ কোনো সুযোগ সুবিধাও পাওয়া যায় না। এসব কারণে মেডিক্যালের ফরেনসিক বিভাগে পড়তে চান না কেউ। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল এনাটমি, ফিজিওলজি ও জুরিসপুডেন্স (ফরেনসিক)। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ফরেনসিক বিভাগ। এই বিভাগের সঙ্গে আইনের একটা সম্পর্ক আছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এখন মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এই বিষয়গুলো ঠিক মতো পড়ানো হয় না। ডাক্তাররা উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য এই বিষয়ে পড়তে আগ্রহী নয়। এখানে পড়লে পচা-গলা লাশের ময়নাতদন্ত করতে হয়। সাক্ষী দিতে হয়, সারাদেশে গিয়ে। সেটা কারো পক্ষে যায়, কারো বিপক্ষে যায়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গেলে জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়। তার জন্য নেই কোনো নিরাপত্তা। এই অবস্থার ফলে মেডিক্যাল কলেজে যে পড়াশোনা হচ্ছে, তাতে ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না। যা একটা দেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, সারাদেশে ৩০টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ফরেনসিক বিভাগে আছেন মাত্র ৫ জন অধ্যাপক, ৬ জন সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক ৬ জন। সব মিলিয়ে ফরেনসিক বিভাগে ৩২ জন শিক্ষক আছেন। সরকারি ৩০টি মেডিক্যাল কলেজের বাইরে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ যেখানে ৬৯টি। অথচ অন্য সব বিষয়গুলোতে এক একটি বিভাগে কয়েকশ’ করে অধ্যাপক রয়েছেন। সিনিয়র অধ্যাপক বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আছেন অসংখ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরেনসিক বিভাগ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারপরও ছাত্র-ছাত্রীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন এসব বিভাগে বাড়তি সুযোগ সুবিধা বা প্রণোদনা দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন অনেকেই। এর বাইরে অধিকাংশ সরকারি মেডিক্যাল কলেজে মর্গ নেই, নেই মরচুয়ারি। জেলায় সিভিল সার্জনের অধীনে একজন আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ময়নাতদন্ত করেন। তাদের এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। পড়াশোনাও নেই। এই অবস্থায় চলছে সারাদেশের ময়নাতদন্ত। এতে করে স্বজনহারা মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সম্প্রতি একজন বিচারক ময়নাতদন্তের রিপোর্টের পর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘যে ময়নাতদন্ত হচ্ছে তার ৯৯ ভাগই ত্রুটিপূর্ণ।’ চিকিৎসকরাও এটা স্বীকার করেছেন। তারাও এ বিষয়ে সরকারকে মনোযোগী হওয়ার অনুরোধ করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক কনসালটেন্স ও আন্তর্জাতিক খাতি সম্পন্ন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘ফরেনসিক বিষয়ে একিউট ক্রাইসিস চলছে। এই বিভাগের চিকিৎসকদের বিদেশে প্রশিক্ষণের তেমন কোনো সুযোগ নেই। ৩০টি মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক বিভাগে যে সংখ্যক শিক্ষক থাকার কথা সেটা নেই। যারা এ বিষয়ে হাতে কলমে শেখার জন্য আসে তারাও কিছুদিন পর ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টে চলে যায়।’ তার মতে, সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আধুনিক মর্গ ও মরচুয়ারিও নেই। যে ধরনের উপকরণ থাকা দরকার তাও নেই। জেলায় জেলায় যে ময়নাতদন্ত হচ্ছে, সেখানে আরএমওদের পড়াশোনাও নেই, প্রশিক্ষণও নেই। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এই বিভাগের বিষয়ে সরকারকে আগ্রহী হতে হবে।
অন্তত ৭টি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তারা বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বারবার বলেছি, ভালো চিকিৎসক তৈরি করতে হলে এই বিভাগগুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব বিষয়ে চিকিৎসকের তীব্র সংকট রয়েছে। এখন যারা আছেন তারা অবসরে গেলে ফরেনসিকের আর কোনো চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশেষ প্রণোদনা ছাড়া এই বিভাগে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (মেডিক্যাল এডুকেশন) অধ্যাপক ডা. আব্দুর রশীদ বলেন, ‘এই বিষয় নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে দেনদরবার করেই যাচ্ছি। কিন্তু কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না, কেউ বুঝতেও চাচ্ছেন না। মেডিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরো ক্ষতি হবে। কারণ এই বিষয়গুলোতে শিক্ষক নেই। এসব বিষয়ে প্রণোদনা বা সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে যোগ্য চিকিৎসক তৈরি করতে হবে দেশের স্বার্থে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের ৬৯টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ আছে। আর সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৩০টি। বেসরকারি মেডিক্যালগুলোতে কি পড়ানো হচ্ছে, তার কোনো খোঁজ আমরা রাখতে পারছি না। কারণ অধিদফতর ব্যস্ত সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো নিয়ে। ফলে বেসরকারি মেডিক্যাল থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিখে চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছে সে বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখছেন না কেউই।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘ফরেনসিক বিষয়ে ডাক্তাররা যাতে পড়তে আসেন, উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আসেন- এ জন্য প্রণোদনাসহ বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা আমরা ভাবছি। এ ব্যাপারে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। ইত্তেফাক