খােলা বাজার২৪, বুধবার, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭: কুমিল্লার লাকসাম পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র দৌলতগঞ্জ বাজারের কাপড়িয়াপট্টি, স্বর্নপট্টি ও মনোহরীপট্টিতে গত শুক্রবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কল্যাণে ২/১টি বিচ্ছিন্ন আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস ছাড়া দৃশ্যমান তেমন কোন উদ্যোগ গত ৫ দিনেও দেখা যায়নি। বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তর শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা আর তালিকা প্রণয়নেই ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে দুর্ঘটনার ৪ দিনের মাথায় পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীসহ ক্ষতিগ্রস্ত মালিক পক্ষের লোকজনের সমন্বয়ে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের তান্ডবলীলায় ধ্বংসস্তুপ সরাতে দিনরাত কাজ করছেন। এ কাজে সহযোগিতা দিচ্ছেন লাকসাম থানা পুলিশ। দৃশ্যতঃ ওই ৩টি গলির ব্যবসায়ীক কর্মকান্ড অত্রাঞ্চলের গ্রামীন অর্থনীতির চাকা স্বচল রাখতো। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ বাজারটি সারাদেশে প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু চোখের পলকেই অগ্নীদানবের তান্ডবে সবই যেন বিরাণভূমি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মাঝে অজানা আতংক আর আর্তনাদের নির্ঘুম একটি রাত কেটেছে; চোখের সামনেই হারিয়ে গেলো সবকিছু। ভয়াল এ ধ্বংসলীলার স্তুপ দেখে ক্ষতিগ্রস্ত বহুসংখ্যক ব্যবসায়ী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৯ ঘন্টার অগ্নিতান্ডবে ৩টি গলির ছাই হলো ছোট-বড় ২ শতাধিক দোকানপাট। চেয়ে চেয়ে দেখা আর ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া গত্যান্তর ছিল না তাদের। আগুনে পুড়েছে তিলে তিলে গড়ে তোলা ওইসব ব্যবসায়ীর স্বপ্ন। পলকেই নিঃস্ব হয়েছেন একাধিক কোটিপতি ব্যবসায়ী। অগ্নিকান্ডের প্রভাবে এ এলাকার ব্যাংক, বীমাসহ অন্যান্য আর্থিক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ধ্বস নেমেছে। স্মরনকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সর্বস্ব হারালেন অসংখ্য ব্যবসায়ী এবং বেকার হয়ে পড়েছে ওইসব দোকানের প্রায় সহস্রাধিক কর্মচারী। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৌলতগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ্ব আক্তারুজ্জামানের সভাপতিত্বে এক জরুরী সভা বসে। সভায় ওই সমিতির ৩৮টি পন্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদককরা বক্তব্য রাখেন। সবাই অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সকল ব্যবসায়ীদের সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহবান জানান। এ মহাদূর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ায় ওই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বিছনাপট্টিসহ আশে পাশের গলিতে চলছে শোকরানা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
জানা যায়, ওইদিন এ অঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র দৌলতগঞ্জ বাজারের কাপড়, স্বর্ণ ও মনোহরী পট্টিতে ছোট-বড় প্রায় ২ শতাধিক দোকান দানবরূপী অগ্নিকান্ডের ধ্বংসলীলায় লন্ডভন্ড হয়ে মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। দীর্ঘ ৯ ঘন্টা অগ্নিতান্ডবে রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তুপ যেন স্থানীয় সকল শ্রেণি-পেশার ব্যবসায়ীদের গ্রামীণ অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। ভয়াল এ তান্ডবে পৌর শহরের ব্যাংক, বীমাসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। যেন কাঁদছে পুরো লাকসাম। ওই তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্তরা সবাই যেন সহায়-সম্বল হারিয়ে একাকার হয়ে গেছেন। তাদের বোবাকান্না আর আত্মচিৎকার-আহাজারিতে পুরো শহর যেন মুখ গুমড়ে কাঁদছে। সরকারিভাবে প্রায় ৮৮ কোটি ৩৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষলেও এ অংক ৮/১০ গুণেরও বেশি হবে বলে একাধিক ব্যবসায়ী সূত্র জানায়। এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এলাকার পুরো গ্রামীণ অর্থনীতিকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে ব্যবসায়ী মহল বেচা-কেনার ক্ষেত্রে পড়েছেন বেশ চাপে। স্থানীয় লোকজন জানায়, ওইদিন আকস্মিকভাবে পৌর শহরের সবচেয়ে ঐতিহ্য বহনকারী বিনিয়োগবহুল ব্যবসা কেন্দ্র কাপড়, স্বর্ণ ও মনোহরী পণ্যের ৩টি পাইকারী মার্কেটের ছোট-বড় ২ শতাধিক দোকান-পাট ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে চোখের পলকেই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। খবর পেয়ে লাকসাম থানা পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে আসলেও দমকল বাহিনীর কর্মকান্ড নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ। দমকল বাহিনীর অতীত কর্মকান্ডেও রয়েছে বিতর্ক। পরবর্তীতে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের ১০টি দমকল ইউনিট স্থাণীয় লোকজনের সাথে যোগ দিয়ে প্রায় ৯ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে পরদিন সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাধিক সূত্র জানায়, ওইরাতে আগুনের দাপট ছিল দানবীয়। চোখের পলকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ৩টি গলির একের পর এক সকল দোকানপাটে। ওই সময়ে স্থানীয় লোকজনের আত্মচিৎকার, আতশবাজির বিস্ফোরণ আর পুলিশ-দমকল বাহিনীর বাঁশির আওয়াজে পুরো পৌর শহর কাঁপিয়ে তোলে। এ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা যেন ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। খবর পেয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ-র্যাবসহ অন্যান্য সংস্থা, লাকসাম উপজেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের আন্তরিকতা ও সার্বিক তদারকিতে হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। এ মহা দুর্যোগে কাপড়িয়াপট্টির প্রায় ১০টি পাইকারী কাপড় দোকান ও ৩৩টি খুচরা দোকান, স্বর্ণপট্টির ১৬টি জুয়েলারি শো-রুম ও ৪০টি জুয়েলারি কারখানা, মনোহরিপট্টির ১১টি কসমেটিক দোকান এবং ওই এলাকায় ২টি শুকনো মরিচের আড়ত, ২টি মুদি দোকান, ৫টি সুতা-রসির দোকান, ২টি খাবার হোটেল, ১টি চা-দোকান, ২টি লাইব্রেরী, ২টি তৈল মিলসহ ছোট-বড় ২ শতাধিক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ১৪৮। এরমধ্যে ৮২ জন দোকানঘরের মালিক ও ৬৬ জন ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী এবং ক্ষতিগ্রস্ত দোকানঘরের সংখ্যা ১’শ২৩ বলে উল্লেখ করা হয়। এ আগুনে মান্দাতা আমলের বেশিরভাগ টিনশেড ঘরের পাশাপাশি পুড়ে গেছে অনেক দালান-কোঠাও। ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি হিসেবের খাতায় বড় ধরনের গড়মিল বিধায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাঝে উঠেছে নানা গুঞ্জন। তবে প্রকৃত বিনিয়োগ সম্পর্কে মুখ খুলছে না অনেকেই ফলে সঠিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র অনেকটাই অনুপস্থিত। বিশেষ করে সরকারি রাজস্ব খাতে আয়কর ফাঁকির বিষয়টি জড়িত থাকায় ক্ষয়ক্ষতির সঠিক চিত্র স্থানীয় মিডিয়াকর্মীদের দিচ্ছেন না কেউ কেউ।
এদিকে, অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত নিয়ে স্থানীয় জনমনে নানা গুঞ্জন ঢালপালা মেলেছে। তবে দমকল বাহিনীসহ একাধিক দপ্তর এ অগ্নিকান্ডকে বিদ্যুতের শর্টসার্কিট বলে প্রাথমিকভাবে সূত্রপাতের ধারণা দিলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের একাধিক সূত্র বলছে ভিন্নকথা। তাদের দাবি- মনোহরিপট্টির একটি কসমেটিক দোকানে অরক্ষিতভাবে থাকা ভারতীয় আতশবাজির বিস্ফোরণেই এ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হতে পারে। ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে এ অঞ্চলে অতীতের রেকর্ড ভেঙ্গেছে এ অগ্নিদানব। এতোবড় মহাদুর্যোগ শতবছরেও এ অঞ্চলে ঘটেনি। স্থানীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করায় অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও হতাশ হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানায়, এ মহাদুর্যোগের শিকার হয়ে আমরা সহায়-সম্বল হারিয়ে মহাজন, ব্যাংক ঋণসহ নানাভাবে দায়-দেনায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছি। আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে সকল মহলের সহযোগিতার হাত বাড়াতে অনুরোধ করছি। বিশেষ করে, এ মহাদুর্যোগের চিত্র পরিদর্শনে ওনারা আসলেন, সবকিছু দেখলেন কিন্তু আমাদের জন্য কি করলেন! শুধু অপেক্ষা ছাড়া আর কি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ২/১টি আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস ছাড়া সরকারি-বেসরকারিভাবে শুধুমাত্র তালিকা আর তালিকার খবর শুনতে পাচ্ছি। দেখা যাক- ভালো কিছু হলে অবশ্যই জানবেন।
স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, ওইদিনের অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। সরকারিভাবে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় বিত্তশালীদের কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা গেছে। অপরদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক, সংসদ সদস্য মোঃ তাজুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাংগীর আলম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন, লাকসাম উপজেলা চেয়ারম্যান এড. ইউনুছ ভূঁইয়া, পৌর মেয়র অধ্যাপক মোঃ আবুল খায়ের, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী, দৌলতগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আক্তারুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক তাবারক উল্যাহ কায়েস ও লাকসাম প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক এড. রফিকুল ইসলাম হিরাসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও বিত্তশালি ব্যক্তিরা।