খােলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি ২০১: স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও একটি প্রশ্নের জবাব জাতি পায় নাই। প্রশ্নটি হচ্ছে – জহির রায়হানের ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের নিস্পৃহ আচরণ। একটি মানুষ যে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কেউ যেন তার খোঁজ রাখল না। আমরা ঘাতক দালাল নির্মূলের কথা বলি, যু্ধাপরাধিদের ফাঁসি দাবি করি। অথচ জহির রায়হানের নামটি চলচ্চিত্র জগৎ ছাড়া আর কোথাও উচ্চারিত হয় না। কেন হয় না, সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো কেউ এদেশে নেই ?
সোমবার সকালে রাজধানীর যাদু মিয়া মিলনায়তনে ‘জহির রায়হানের ৪৫তম অন্তর্ধান দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ যুব ন্যাপ আয়োজিত এক স্মরণসভায় আলোচকবৃন্দ উপরোক্ত বক্তব্য রাখেন।
সংগঠনের আহ্বায়ক বাহাদুর শামিম আহমেদ পিন্টুর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া। আলোচনায় অংশগ্রহন করেন ন্যাপ যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ শাহজাহান সাজু, সম্পাদক মোঃ কামাল ভুইয়া, নগর সদস্য সচিব মোঃ শহীদুননবী ডাবলু, জাতীয় ছাত্র কেন্দ্রের যুগ্ম সমন্বয়কারী সোলায়মান সোহেল, যুব ন্যাপ যুগ্ম আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান পলাশ প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেছেন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন জহির রায়হান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। এ সময় তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে কেন্দ্র করে তৈরী করেন প্রামাণ্যচিত্র। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে এসে জহির রায়হান তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টায় নিজেই আহ্বায়ক হয়ে এনায়েতউল্লাহ খান, সৈয়দ হাসান ইমাম, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. সিরাজুল ইসলাম প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে বেসরকারিভাবে গঠন করেন ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’। অথচ কি অবাক ব্যাপার, অপহৃতদের খুনের রহস্য খুঁজতে গিয়ে নিজেই অন্তর্ধানে চলে গেলেন। দুই সহোদরের কোন খোঁজ মিললোনা এই স্বাধীন দেশে। সরকারি ভাবে কোন কার্যকর অনুসন্ধান ও হলো না। মুক্তিযুদ্ধে ও বাংলা চলচ্চিত্র সৃজনশীল এ মানুষটির অবদানের কথা আজকের প্রজন্ম প্রায় ভুলতে বসেছে।গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে ৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জহির রায়হান বলেছিলেন, “বুদ্ধিজীবী হত্যার অনেক রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। আমাদের কাছে এমন অনেক তথ্য ও প্রমাণ আছে, যা প্রকাশ করলে অনেকের মুখোশ খুলে যাবে। সময় বুঝে আমি একেক করে সব প্রকাশ করব” অনেকের মতে এ ঘোষণাই তাঁর জন্য কাল হল। আবার অনেকে মনে করেন অন্তর্ধানের পরও অনেকদিন জহির রায়হানকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল!
তিনি আরো বলে, প্রকৃত অর্থে কি ঘটেছিল তা শুধু অনুসন্ধান আর তদন্ত সাপেক্ষেই বলা সম্ভব। তবে নিঃসংকোচে এটা বলা যায় তৎকালীন সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তে যথাযত পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারেনি। তখন এ রহস্য উদ্ঘাটন অনেক সহজ ছিল। তখন তা করা হয়নি, পরেও কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি বরং জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তও সেখানেই থেমে যায়।
আমারা আজ জহির রায়হান অন্তর্ধান দিবস পালন করছি, তাকে বিক্রি করছি। জাতি হিসেবে তাঁর দাঁয় শোধ করতে পারিনি। অনেকেই নিখোঁজ হয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর একটা স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে তিনি হারিয়ে গেলেন নিজের ভাইকে খুঁজতে গিয়ে? তাঁর মৃত্যুতে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হল – বুদ্ধিজীবী হত্যা অনুসন্ধান থেমে যাওয়া। বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত ও জহির রায়হানের অন্তর্ধান ঘটনা দুটি গভীর ভাবে জড়িত। কারন তিনি শুধু তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভাইকেই খুঁজছিলেন না, তাদের অন্তর্ধানের ও হত্যার রহস্যও খুঁজে ফিরছিলেন এবং এটা বিশ্বাস করাই যায় যে- তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তবে এ হত্যা রহস্যের কারন বাঙালী জাতি জানতে পারতেন।
সু-সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।